সংকটে সুন্দরবন, সেই নৌপথ বন্ধ হয়নি

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চালু হওয়া নৌপথের কারণে পূর্ব সুন্দরবন প্রাণীশূন্য হতে শুরু করেছে। প্রতিদিন প্রায় ১৫০টি বিশাল আকৃতির নৌযান বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এসব নৌযানের ঢেউ, ফেলে যাওয়া বর্জ্য তেল ও শব্দদূষণের কারণে বনের দুই পাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বৃক্ষ, লতা, গুল্ম মরতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে বনের জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে। sundorban
বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলোতে জাহাজ থেকে বর্জ্য তেল ফেলা হচ্ছে এবং প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে বনের পাড় ভাঙছে। বন বিভাগ থেকে এমন অভিযোগ নৌপথ চালুর সময় অর্থাৎ ২০১২ সালের নভেম্বরেই তোলা হয়েছিল। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে সুন্দরবন রক্ষার আশ্বাস দিয়ে ওই নৌপথ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত দেড় বছরেও তা বন্ধ হয়নি। বরং দিনকে দিন বনের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী নৌযানের সংখ্যা বেড়েছে। ক্ষতিও বাড়ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার এই নৌপথের শুরুতেই সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে একটি সিমেন্টবাহী কার্গো ডুবে গেছে। ১১ হাজার সিমেন্টের বস্তাসহ এমভি মোতাহার নামের কার্গোটি বনের মধ্যেই নোঙর করে অবস্থান করছিল।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যে এলাকা দিয়ে এই নৌপথ চালু হয়েছে, অর্থাৎ পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ কম। ফলে সেখানে বাঘ, হরিণ, কুমির, সাপ, বানর, পাখিসহ সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীদের বসবাস। এখানকার মুগমারীকে বন বিভাগ কুমিরের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে ঘোষণা করেছে। গত বছর এই এলাকাকে ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
সুন্দরবন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণারত বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নৌযানগুলো ওই পথ দিয়ে চলাচল করায় সেখানে আর আগের মতো বন্য প্রাণী দেখা যাচ্ছে না। গতকাল ওই পথ দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খানের নেতৃত্বে একটি দল সফর করে ফিরেছে। তারা নৌপথের বাইরের এলাকা কচিখালি ও সুপতিতে হরিণ, কুমির, সাপ, পাখিসহ অনেক বন্য প্রাণী দেখতে পেয়েছে। কিন্তু নৌপথের দুই পাড়ে কোনো হরিণ ও কুমির দেখতে পায়নি।
মনিরুল খান এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে সুন্দরবনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা পূর্ব সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাস অনুযায়ী অবশ্যই এই নৌপথ বন্ধ করতে হবে। নয়তো সুন্দরবনের এমন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, যা আর কখনো পোষানো যাবে না।sundrban1
ভাঙন বাড়ছে, গাছ মরছে: যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বন্য প্রাণীবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির বাংলাদেশ স্তন্যপায়ী প্রাণী প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের ভেতরের নৌপথের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা চলছে। তাতে দেখা গেছে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০টি নৌযান চলে। এতে বনের নদীগুলোতে ঢেউয়ের গতি ও উচ্চতা বেড়ে গেছে। ফলে বনের দুই পাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। চাঁদপাই, নন্দবালা, জয়মনি, তাম্বুলুবুনিয়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় গাছের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। গাছগুলো মরতে শুরু করেছে। পাড় ভাঙনের ফলে চাঁদপাই বনফাঁড়িটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
জানা গেছে, বনের যেখানে-সেখানে জাহাজ নোঙর করা হচ্ছে। ওই জাহাজে সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর কোনো বস্তু আছে কি না, তা কেউ তদারক করছেন না। যাঁরা নোঙর করে অবস্থান করছেন, তাঁরা বনের মধ্যে বর্জ্য তেল ফেলছেন কি না, বা তাঁদের ফেলে যাওয়া কোনো পদার্থের কারণে বনের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না, তা-ও দেখভালের কেউ নেই।
১৮০ কিলোমিটার ঘুরতে হচ্ছে: মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, এর আগে খুলনা হয়ে মংলা বন্দরের দিকে নৌযানগুলো ঘসিয়াখালী খাল দিয়ে আসা-যাওয়া করত। প্রায় নয় কিলোমিটার আয়তনের ওই খালটি খননের অভাবে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে বিআইডব্লিইউটিএ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সন্ন্যাসী-রায়েন্দা-বগী-শরণখোলা-দুধমুখী-হরিণটানা-আন্ধারমানিক-মুগমারী-চাঁদপাই-জয়মণিরগোল হয়ে মংলা বন্দরে যাওয়ার অনুমতি দেয়।
এই নৌপথের দুই পাশ হরিণটানা, বগী, চাঁদপাই, জয়মণিরগোল এলাকাটি হরিণ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র। এই এলাকা পৃথিবীর সবচেয়ে কম জায়গায় সবচেয়ে বেশি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিচরণের জন্য বিখ্যাত। এই পথ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দেড় শ জাহাজ ও কার্গো যাতায়াত করায় সেখান থেকে বন্য প্রাণী অন্যত্র চলে যেতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান মো. সামসুদ্দোহা খন্দকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি গতকাল প্রথম আলোকে আবারও আগের পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘ঘসিয়াখালী খাল খননের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে এখনো অর্থ না পাওয়ায় তা শুরু করতে পারিনি। আশা করছি, দ্রুত তা শুরু করা যাবে।’
এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারি ও গত জানুয়ারিতে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সুন্দরবনের ভেতরের ওই নৌপথের বিপদ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবারই বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ পরের মাসেই ঘসিয়াখালী খাল খনন হচ্ছে বলে জানিয়েছিল।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান ভূইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ঘসিয়াখালী খালের মাত্র আট কিলোমিটার এলাকা খনন না করায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসা নৌযানগুলোকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয়। এতে জ্বালানি খরচ ও সময় বেশি লাগছে। বিষয়টি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে একাধিকবার উত্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলুক এটা আমরাও চাই না। কেননা, এতে বনের জীববৈচিত্র্যেরও ক্ষতি হচ্ছে।’
২০১১ সালের নভেম্বরে প্রথম সুন্দরবনের ভেতরে নৌপথ চালু হয়। দিনে ২০ থেকে ২৫টি নৌযান বনের ভেতর দিয়ে চলত। বর্তমানে তা দেড় শয় পৌঁছেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০, বন আইন অনুযায়ী সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এ ধরনের নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। জাতিসংঘের রামসার কনভেনশন অনুযায়ী সুন্দরবন একটি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। ওই কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে স্বাক্ষর করে। এর শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর কোনো ধরনের তৎপরতা চালাবে না। অথচ উল্টোটাই ঘটছে।

সুত্রঃ প্রথম আলো, ১৫,০৩,২০১৩

Check Also

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র: নদী, নিরাপদ পানি ও মানুষের গল্প

দূষণের এই চিত্র শুধু পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের না, সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নদীরই। কোরোনাকালীন এই দূর্যোগে দূষণমুক্ত নদী হতে পারতো দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপদ পানির অন্যতম উৎস। আমরাই দূষণের মাধ্যমে মানুষকে অন্য উৎসের দিকে ঝুকতে বাধ্য করেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক দলের চমৎকার আবিষ্কারঃ শৈবাল থেকে ন্যানো-ফিল্টার

লেনা আলফি সম্প্রতি শৈবাল থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ ন্যানো ফিল্টার তৈরি করে সারাবিশ্বে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *