জল-করচের মিতালী : রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট

প্রথমবার রাতারগুল যখন গেলাম তখন ফেব্রুয়ারি মাস প্রায় শেষ। শুক্রবার। ২০১১’র বর্ষায় ফরেস্ট্রির অনিমেষ চ্যানেল আই’র মুশফিক ভাই এর সাথে ডকুমেন্টারি শুট থেকে ফিরে আসলে ওর মুখে শুনি বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুলের কথা। ডিপার্টমেন্টের পিকনিকের জন্য নতুন কোন সাইট দরকার। তারই ফিজিবিলিটি অ্যানালাইসিসের জন্য খাদিমনগরের ব্যর্থতার পরে যাওয়া হরিপুরের রাস্তা ধরে রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। কিন্তু বড় বাস যাবেনা বলে পিকনিকে আর যাওয়া হয়নি। তবে সেবার শুকনোর মউশুমে অদ্ভুত আলোর বিকেলে সোয়াম্পের পাতা ঝড়া বনে ঘুরে বেড়িয়েছি। আর জেনেছি শুকনো নদী থেকে আরও প্রায় ৪০ ফুট পর্যন্ত পানি উঠে যায় ঢলের সময়ে। তখন জায়গাটা যে কতোটা রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে শুধু কল্পনা করেছিলাম। যা হোক, টিচার্স ডর্মিটরি প্রজেক্টটা সাবমিট করেই হাতে দু’দিন সময় পেলাম। সিলেটী বৃষ্টি ক’দিন ধরেই তার স্বরূপে দেখা দিচ্ছিলো। ভেবেই রেখেছিলাম একটা ফটো আউটিং হবে। এর মাঝেই সঞ্জয়ের ফোন পেলাম ‘দোস্ত, টার্ম শেষ। আমরা আসতেছি’।

শুকনার সময় ফরেস্টের ‘বেড’

(গতবারের ছবি)

ওদের ভোর বেলাই পৌঁছে দিলো। কিন্তু সকাল থেকেই এমন টানা বৃষ্টি আরম্ভ হল, ওরা তো মুখ চুন করে ২৯ খেলা শুরু করে দিলো। দুপুর পার হয়ে গেলে একরকম জিদ করে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নিয়েই বেরিয়ে পরলাম। আমরা আমলা-কামলারা ছয়জন আর সঞ্জয়-রিমনরা চারজন মিলিয়ে দশজন। লোকাল সি.এন.জি-তে প্রথমে আম্বরখানা। খরচ কম, মাথা পিছু দশ টাকা। সেখান থেকে শালুটিকর-সাহেবের বাজার লোকাল ভাড়ায় যায় এমন সি.এন.জি খুঁজে বের করা। সাহেবের বাজার পর্যন্ত ২৫ টাকা করে পাঁচজন ১২৫ টাকা স্বাভাবিক ভাড়া। কিন্তু আমরা যাবো আরো একটু সামনে, জলুর মুখ পর্যন্ত তাই ২০০ টাকা ঠিক হল। আশা করছিলাম এতোদিনে ঢলের পানি বেড়ে গিয়েছে। শালুটিকরের রাস্তা ধরে আমরা এগোচ্ছিলাম, ১২ ফুটের গ্রামীণ রাস্তা; তবে পীচ ঢালা। সাহেবের বাজার পার হতেই হাতের বাম দিকে হাওরের পানি উঁকি দিতে দেখলাম যখন, সত্যিসত্যিই মনটা নেচে উঠলো। পানি যে অনেক বেড়ে গিয়েছে বুঝতে পারলাম। রাস্তাটা ‘ওয়াই’ শেপ হয়ে একদিকে চলে গিয়েছে হরিপুর, আরেকটায় ‘প্যাকের রাস্তা’র দিকে। প্যাকের রাস্তায় গিয়ে কাদাপথের আগে সি.এন.জি থেকে নেমে পড়লাম আমরা। ফিরতি পথে এখানথেকে সি.এন.জি পাওয়া যায়না, শুকনার সময় অবশ্য জলুর ঘাট থেকে মাছের গাড়ি যায়, তবে ওই পর্যন্ত এই সময় আর যাওয়া যায় না। তাই সি.এন.জি ওয়ালার নম্বর নিয়ে নিলাম। ওরা প্রতি ঘন্টায় সাহেবের বাজার পর্যন্ত আসে।

হাওরের মাঝ দিয়ে রাস্তা। দুপাশে অনাবাদি জমিতে পানি। রোদ-নেই বিকেল। দক্ষিণ থেকে স্নিগ্ধ বাতাস আসছে, আমরা শুধু শোঁ-শো আওয়াজ পাচ্ছি ডান কানে। আবহাওয়ার কারণে পাখির আশা করছিলাম না তেমন। তবে বক, পানকৌরি, মাছরাঙাদের মতো মেছোদের আনাগোনা ঠিকই ছিল। কিছুদূর এগিয়েই লোকালয় পার হতে পূর্ব দিকে দৃষ্টিগোচর হল সোয়াম্পের গাছ গুলোর মাথা। যে গোয়াইন নদীর বাঁধ বেয়ে নিচে প্রায় ত্রিশ ফুট নেমেছিলাম আগেরবার, তার চিন্হ পর্যন্ত নেই। পানি নিচ থেকে বাঁধ পর্যন্ত তো উঠেছেই, তারপর প্রায় ১০-১২ ফুট উঠে গাছগুলোকে প্রায় পুরোটাই গিলে ফেলেছে।  স্লিং ব্যাগে আমাদের তিন জনের ক্যামেরা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। ছবি নেবনা হতেই পারেনা! ১৮-১৩৫ হাতে রনিই এগিয়ে গেল। জলুঘাটের রাস্তা অর্ধেক পথে একটা পুল ছিল। পুলের আগেই রাস্তাটায় পানি ভরে গিয়েছে। সেখানেই জেলেদের ডিঙি পেলাম আমরা। একটা বড় মেশিন নৌকাও দেখলাম, তবে মাঝি নেই তাতে। ২০০ টাকা করে দুটো ডিঙি নিলাম আমরা; চুক্তি হল বনের মাঝ দিয়ে ডিঙি নিয়ে যাবো, বিট অফিস ঘুরে জলুর ঘাট বাজারে নাস্তা করে আবার মোটর ঘাটে ফিরে আসবো। পাঁচজন করে বসে পরলাম নৌকায়। মাঝি আমাদের বয়সেরই। রাতারগুল মূলত: হল করচ (Pongamia pinnata) গাছের মিঠপানির সোয়াম্প ফরেস্ট। ঢলের পানি বর্ষায় যখন গোয়াইন নদী হয়ে ঢোকে, তখন প্রায় পুরোটাই পানির নিচে চলে যায়। আগে হাকালুকি কিংবা টাংগুয়ায় এরকম গাছের বন ছিল যা এখন নেই বললেই চলে। ৮-৯ ফুটের মোডিফাইড রুট গুলো শাখা-প্রশাখা বিহীন, শুকনার সময় দেখলেই বোঝা যায় কতোদূর পানি উঠে যায়। এবার দেখে মনে মনে বেশ ভয় পেয়েছিলাম কেননা এসব গাছ বর্ষায় সাপের জন্য খুব লোভনীয় জায়গা। নৌকাগুলো দুটো গাছের মাঝের অল্প জায়গার ভেতরদিয়ে মাঝে মাঝেই পার হচ্ছিলো; খুব সাবধান থাকতে হয়েছে তাই। শঙ্খচিলদের দেখা পাচ্ছিলাম।ঢলের পানি তাদের জন্য আশির্বাদের ‘প্লেন্টি’! মাগুর, বোয়াল, চিতল, আইড়ের মতো মাছগুলো এসময় জেলে মানুষ আর জেলে পাখিদের ভাগ্য খুলে দেয়। বনে মানুষের প্রবেশ এসময় একদমই কম। জেলেরা কাজ করে বনের পেরিফেরির দিকে। আমরা এগোতে থাকলাম করচ বনের মাঝ দিয়ে। গাছের মাঝে হঠাত চাঞ্চল্য বানরদের অবস্থানের জানান দিয়ে গেল। মাঝি দুজনই আমাদের বয়সী। নৌকা বাইতে বাইতে আমরা বেশ মজা করে আড্ডা দিচ্ছিলাম। দাড় মাঝিদের হাতে দুটো, আমাদের হাতে দুটো। কখনো কখনো হচ্ছিলো রেস, আবার কখনো একমাত্র দেশলাইয়ের বাক্সের জন্য খুনসুটি। তবে সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছিলাম জল-করচের মিতালী। বনের বাইরের দিকে ভাসমান কচুরিগুলোতে ছিল হাজার রকম অদ্ভূত রঙের পোকা মাকড়, সাথে ছোট ছোট জোঁক। সুযোগ পেলেই হিচ হাইকারের মতো উঠে যেত নৌকায় আর শুরু হতো সঞ্জয়ের চিতকার! লম্বা ঘাসের স্পর্শও একসময় চমকে দিতো।

   

অপেক্ষায় শঙ্খচিল

রাশেদ ভাই বলছিলো ‘নিচে লক্ষ রাখ, কখন বিশাল অ্যানাকোন্ডা পানি ফেঁড়ে উঠে এসে বলবে ‘কিতা বে, বালা নি?’ চিকন লম্বা পায়ের মাকড়সাগুলো জিশুর মতো পানির উপর দিয়ে দিব্যি হেঁটে হেঁটে চলছিলো। দেখতে দেখতেই আমরা নদীর ওপরে এসে পৌঁছে গেলাম। নদীর পানি আর হাওরের পানির একটা স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছিলো। ভাবছিলাম বিট অফিসার সাহেবের সাথে দেখা করে যাবো। কিন্তু সে সময় আর হলো না। কিছুদূর এগিয়ে আবার পথ পরিবর্তন করে জলুরমুখ বাজারের দিকে নৌকা ঘোরানো হলো। নদীতে অথৈ পানি। উঁচু জায়গায় যেসব বাড়ি ঘর রয়েছে সেগুলোকে একেকটি দ্বীপের মতো দেখাচ্ছিলো। আগের বার বিট অফিস যেতে মুচি পাড়া দেখেছিলাম একটা। শুকরের কর্কশ আওয়াজ শুনে বুঝলাম হ্যাঁ, ঠিক পথেই এগোচ্ছি। জলুরমুখ নেমে জুতো খুলো দেখলাম জোঁক ধরেছে কি না। বাজারে পৌঁছে নিমকি-চা দিয়ে নাশতা করলাম। কাঁচা সুপারি দিয়ে পান মুখে নিয়ে বুটজোড়া পায়ে দিয়ে আবার রওনা দিলাম। সি.এন.জি ওয়ালা লতিফ ভাইকে ফোন দিয়ে দিলাম এদিকে চলে আসবার জন্য। যাবার পথে একটি দ্বীপে এলাকার মসজিদ আছে বলে মাঝি বলল। কিছু টাকা মসজিদের উন্নয়নে দিলাম আমরা। দুই নৌকা চলছিলো পাশাপাশি, আমার হাতে বৈঠা। হঠাত লক্ষ করলাম কমলা পেটের বিশাল এক মাকড়সা আমি যেই পাটাতনে বসেছি ঠিক সেটাতে দিব্যি বসে আছে। দূরত্ব ২ ইঞ্চিও না। ভয় পেয়ে নড়েচড়ে উঠলে ছোট্ট ডিঙি নির্ঘাত উল্টাবে। সাহস করে থিতু হয়ে বসলাম। মাকড়সা বড্ড ভয় পাই। অন্য দিকে তাকিয়ে জোরে বাইতে লাগলাম। কতক পরে তাকিয়ে দেখি মশাই আগের যায়গায় নেই। তাকে আর খুঁজে পাই না। লক্ষ করলাম উনি বোধহয় লজ্জা পেয়ে আমার ঠিক নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। দম বন্ধ করে বকি ১৫ মিনিট বৈঠা চালালাম। দি লংগেস্ট আই হ্যাড এভার স্পেন্ট দিস ক্লোজ টু আ স্পাইডার দিস বিগ! ততোক্ষণে প্রায় ছয়টা বেজে গিয়েছে, বৃষ্টিও একদম নেই। মোটর ঘাটের কাছে পৌঁছে গিয়েছি প্রায়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, হাওরের বাতাস যেন বিদায়ের সুর বাজাচ্ছিলো কানে। পানকৌরিরাও ফিরছিলো নিজ নিজ ঘরে। রাতারগুলের সাপ আর পাখিদের সাথে দেখা হলো না এবার। জল-করচের এই অদ্ভূত সুন্দর মিতালী দেখতে আবার আসবো, সন্দেহ আছে কি?

লেখকঃ রেজা নূর মইন, প্রকৃতিপ্রেমী,, সৌখিন ফটোগ্রাফার

ছবি কৃতিত্বঃ লেখক স্বয়ং 

Check Also

ছেঁড়াদ্বীপে দু’দিন : পর্ব-২

‘ছেঁড়াদ্বীপ’ মানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সেইন্টমার্টিনের আশেপাশে এমন দ্বীপের সংখ্যা অনেক। কিন্তু অপেক্ষাকৃত নিকটতম দ্বীপে যাতায়াত সহজ হওয়ার কারণে পর্যটকদের কাছে এর পরিচিত বেশি এবং এই নিকটতমটিই ‘ছেঁড়াদ্বীপ’ হিসেবে পরিচিত।

ছেঁড়াদ্বীপে দু’দিন : পর্ব-১

ঘোরাঘুরি তো অনেক হয়, কিন্তু সময় নিয়ে মনের মতন হা করে সৌন্দর্য গেলা হয়না অনেকদিন। হুট করেই প্ল্যান হয়ে গেল জ্যোৎস্নাশোভিত দুটো রাত সেইন্টমার্টিনে সাগরের ধারে বসে কাটাবো। তখনও কি জানতাম, কি সব নৈসর্গিক দৃশ্য আর অমূল্য কিছু সময় অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য…

2 comments

  1. Expedition in Ratargul swamp forest gives me the feelings as if I was there. It’s simply astonishing that how much treasure of beauties can be had in the native nature around us. Thanks a lot to the writer; want more of the kind in the page.

  2. পড়ে বেশ আনন্দ পেলাম।
    যাওয়ার ইচ্ছে রাখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *