পঞ্চমুখী জবা (লিন্নিয়াসের প্রথম নামকরনের জবা ফুল)

আদি জবা এবং সঙ্কর জবা

জায়েদ ফরিদ

জবাফুলের পৌরাণিক নাম ছিল জপাকুসুম। রামায়ণে এবং সর্বভারতীয় বৈদ্যক স্বীকৃত চক্রপাণির লেখা বইতে জপা নামের উল্লেখ দেখা যায়। রামায়ণ-এর টীকায় লিখিত জপা অর্থ আলতা এবং কুসুম অর্থ ফুল, সেই সূত্রে জপাকুসুম। আর্যদেবতার পূজায় শাদা ফুল ব্যবহারের রীতি প্রচলিত, লাল জবা ব্যবহৃত হয়েছে অনার্য দেবী শ্যামা বা কালীর পূজায়। কার্তিক অমাবস্যায় এই শ্যামা-পূজার সময় প্রদীপের চারদিকে ঝাঁকঝাঁক পোকা এসে ভীড় করে যাদের আমরা শ্যামা পোকা বলে জানি।

উপমহাদেশে বিচিত্র আকার ও রঙের সঙ্কর ছাড়া যে দুরকম আদি জবা দেখা যায় সেগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম হায়বিস্‌কাস রোজা সাইনেন্‌সিস্‌ (Hibiscus rosa sinensis). এর নামকরণ করেছেন ট্যাক্সনমির জনক স্বয়ং লিন্নিয়াস। অবশ্য তিনি যে জবাটি নামকরণের জন্যে ব্যবহার করেছেন তা ছিল বহুদল জবা, পাঁচ পাপড়িওয়ালা জবা নয়।

পঞ্চমুখী জবা (লিন্নিয়াসের প্রথম নামকরনের জবা ফুল)
পঞ্চমুখী জবা (লিন্নিয়াসের প্রথম নামকরনের জবা ফুল)

বহুদল জবাকেই পঞ্চমুখী জবা বলতে শুনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। পাঁচ পাপড়িতে জবার পঞ্চমুখ কল্পনা করা দুরূহ কিন্তু বহুদল জবার অবয়বে দলের বহুমুখিতাকে পঞ্চমুখ বলে ধরে নেয়া সহজ। ভারতে, চীনে, জ্যামাইকা এবং আফ্রিকার কিছু দেশে এই ফুলের পেস্ট দিয়ে জুতা কালো করা হত বলে কোনো কোনো জায়গায় এটা পাদুকা-পুষ্প নামে পরিচিত। চুলের শ্যাম্পু হিশেবে এবং চুল কালো করার ব্যাপারে এর কদর যথেষ্ট হওয়া সত্বেও এর নাম কখনো কেশপুষ্প হয়নি কেন জানি না!

লঙ্কা জবা, মরিচ জবা
লঙ্কা জবা, মরিচ জবা

আদি জবার নিবাস কোথায় এ নিয়ে গবেষণা কখনো স্থিতিলাভ করেনি কারণ বনে জঙ্গলে প্রাকৃতিকভাবে চীন বা ভারতে জবা আর এখন পাওয়া যায় না। তবে ডিএনএ অনুসন্ধান করে হয়তো একদিন এর সুরাহা হতে পারে। রোজা সাইনেন্সিস্‌ বৈজ্ঞানিক নামের অংশ থেকে মনে হতে পারে এর উদ্ভব চীন থেকে কিন্তু এটা নিছক অনুমান মাত্র। তবে চীন থেকে যে এই জবা ইউরোপে ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এ ব্যাপারে বোধ হয় এখন দ্বিমত নেই। বর্তমানে জবার দু’শোরও বেশি প্রজাতি আবিষ্কার হয়েছে যার সবকটি এসেছে মূল ৮ টি জবা থেকে যার একটির নাম হায়বিস্কাস রোজা সাইনেন্‌সিস্‌। বাকী সাতটির মধ্যে ৩টি মরিশাস, ২টি হাওয়াই, ১ টি মাদাগাস্কার ও ১ টি ফিজি দ্বীপের। এই ৮ টি জবাই পরিপূর্ণভাবে সঙ্করযোগ্যতা সম্পন্ন। অধিকাংশ হাইব্রিড জিনগতভাবে সুসঙ্গত নয় বলে একে অপরের সঙ্গে বংশবৃদ্ধি করতে অক্ষম। এইসব সঙ্করক্ষম আদি জবাদের একটি তালিকা নিবন্ধের শেষে উল্লিখিত হল।

চীন-ভারতের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বাণিজ্য ছিল এক সময় যা সমুদ্র পথেই চলতো বেশিরভাগ। অনেককাল আগের কথা, যখন দ্রুতগামী স্টীমশিপ, ফুল্টনের ক্লারমন্ট আবিষ্কার হয়নি। সুয়েজ খালও নির্মাণ হয়নি তখন, যা পরবর্তীকালে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার পথ সংক্ষিপ্ত করতে পেরেছে। পাল তোলা, দাঁড় টানা জাহাজগুলোকে চীন-ভারত থেকে ইংল্যান্ডে যেতে হলে পুরো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে যেতে হত। তখন যাত্রাপথে পড়তো মরিশাস আর মাদাস্কারের বন্দর। ১৭০০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত দুশো বছর ধরে আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে মরিশাস এবং মাদাগাস্কার এই দুটো দ্বীপে বাণিজ্য জাহাজ নোঙ্গর করা হত। এসব জাহাজে থাকতো উদ্ভিদবিদ আর প্রাণীবিদ যাদের নিযুক্ত করা হত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। অতএব এই জাহাজে করেই সঙ্কর জাতের বিভিন্ন জবা ভ্রমণ করে বহুদূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীব্যাপী। আর আদি জবারা হয়তো বিস্তৃত হয়েছে আরো অনেক আগে, কন্টিনেন্টাল ড্রিফটিং এবং পলিনেশীয় জাতির মাইগ্রেশান-এর কারণে, যে সম্পর্কে সঠিক তথ্য এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

হায়বিস্কাস মস্কিউটো (মৃগনাভি গন্ধি সবচে বড় জবা - ১২ ইঞ্চি ব্যাস)
হায়বিস্কাস মস্কিউটো (মৃগনাভি গন্ধি সবচে বড় জবা – ১২ ইঞ্চি ব্যাস)

আইরিশ প্রকৃতিবিদ চার্লস্‌ টেলফেয়ার ১৮১০ সালে মরিশাস দ্বীপে বাস করা শুরু করেছিলেন সপরিবারে। এই নিবেদিতপ্রাণ গবেষক ও উদ্ভাবক দীর্ঘ ২০ বছর ধরে একনিষ্ঠভাবে তৈরি করেছিলেন বিভিন্ন রকমের সঙ্কর যা বিস্তৃত হয়েছিল জাহজ চলাচলের মাধ্যমেই। এ ছাড়া আদি জবার জাত সংরক্ষণে এবং হাইব্রিড নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ইংল্যাণ্ডের কিউ গার্ডেন এবং অপরাপর কিছু উদ্যানকেন্দ্রও।

হায়বিস্কাস কোকিও (সঙ্করে সবচে কম ব্যবহৃত)
হায়বিস্কাস কোকিও (সঙ্করে সবচে কম ব্যবহৃত)

জবা মালয়েশিয়াতে প্রবেশ করেছে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। কিন্তু নেটিভ না হয়েও কেন এটা জাতীয় ফুল হিশেবে স্থান পেয়েছে তা নিয়ে অনেক জল্পনা। ওখানকার কৃষি মন্ত্রণালয় পদ্ম, গোলাপ, ইলাং ইলাং (অপরূপ চাঁপা) সহ বেশ কয়েকটি ফুলের মধ্য থেকে এই জবাফুলকে বেছে নিয়েছে ষাটের দশকে। এর কারণ, পাঁচটি পাপড়িকে তাদের ৫ টি জাতীয় নীতির প্রতীক হিশেবে ধরে নেয়া যায় আবার লাল রঙ উপস্থাপন করতে পারে জাতীয় বিক্রমকে। এই গাছ মালয়েশিয়াতে ৩০ ফুট লম্বা হয় কিন্তু আমেরিকাতে মাত্র ১৫ ফুট। এর আঞ্চলিক নাম বুঙ্গা রায়া অর্থাৎ বড় ফুল। এই ফুলগাছ দিয়ে মালয়েশিয়াতে অনেক জায়গায় রাস্তার বিভাজকও তৈরি করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় ফুল Hibiscus syriacus যাকে লিন্নিয়াস হয়ত মনে করেছিলেন সিরিয়া থেকে উদ্ভূত। এই ফুলকে তারা বলে মুগুঙ্গুয়া যার অর্থ এসেছে ‘চিরন্তন’ থেকে। দেখতে অপরূপ হাওয়াই দ্বীপের স্টেট ফ্লাওয়ার হল Hibiscus brackenridgei যা স্বল্পায়ু, মাত্র ৪-৫ বছর বেঁচে থাকে।

হায়বিস্কাস কুপেরি (বিচিত্রপাতা, অন্যতম আধুনিক সঙ্কর)
হায়বিস্কাস কুপেরি (বিচিত্রপাতা, অন্যতম আধুনিক সঙ্কর)

নিবন্ধের শেষে কিছু সাবধানতার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। জবার অশেষ গুণের মধ্যে একটি স্বীকৃত গুণ হল, মস্তিষ্ক শীতল করা। পৃথিবীর বহু দেশেই এখন জবা-চা পান করা হয় যা তৈরি করা খুব সহজ, আধঘন্টা পাপড়ি জ্বাল করে চিনি মিশিয়ে নিলেই হল। একসময় মিশরীয় ফেরাউনরাও পান করেছে স্বাস্থ্যের জন্যে। এতে রক্ত চাপ বেশ কমে যায় যে কারণে অল্পরক্তচাপের মানুষের জন্যে এটা হিতে বিপরীত হতে পারে। ঋতুস্রাব বর্ধনের জন্যে এর বিশেষ কার্যকারিতা আছে বলে অন্তঃস্বত্ত্বা নারীর জন্যে এটা আদৌ ব্যবহারযোগ্য নয়।

হায়বিস্কাস স্টর্কিআই (ফিজি দ্বীপের জবা)
হায়বিস্কাস স্টর্কিআই (ফিজি দ্বীপের জবা)

৮ প্রকার আদি জবা যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে অধুনা হাজার সঙ্কর। মরিশাস দ্বীপঃ ৩ টি… Hibiscus lilliflorus, Hibiscus fragilis, Hibiscus genevive হাওয়াই দ্বীপঃ ২ টি… Hibiscus arnottianus, Hibiscus kokio ফিজি দ্বীপঃ ১ টি… Hibiscus storckii মাদাগাস্কার দ্বীপঃ ১ টি… Hibiscus schizopetalus

Check Also

মস্তিস্ক ভক্ষক অ্যামিবা !

এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে অনেক ঔষধ  Naegleria fowleri  (নেগেইলারিয়া ফাউলিরি) এর বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে, তাদের কার্যকারিতা অস্পষ্ট; কারণ প্রায় সব সংক্রমণই মরণঘাতি।

অসাধু ব্যবসায়ীক চক্রেই ভেজাল ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা সাধারণ

পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট এর ফল পরীক্ষার তথ্যানুযায়ীই বলতে হয় যে, এ দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল এবং দেহের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর বলেই চিহ্নিত হয়েছে। সারা দেশ থেকেই স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্য দ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *