মোহাম্মদ আরজু
লিখলাম ‘বঙ্গোপসাগর’, ডাকনাম বললে চিনতে সুবিধা, তাই। তবে প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, দুনিয়ায় সাগর আসলে একটাই। দুনিয়ায় এ বিপুল লোনা জলভাগ সম্পর্কের দিক থেকে অখণ্ড, একটিই মহাসাগর আমাদের। বিশ্বে প্রাণ ধারণের উপযোগী যে পরিমাণ জায়গা আছে, তার ৯৭ শতাংশই এ মহাসাগরে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের বিস্তৃত সবুজের দক্ষিণ উপকূলে ৭১০ কিলোমিটারজুড়ে ছুঁয়ে আছে এ বিপুল নীল জলরাশি। সমুদ্র উপকূলীয় দেশ হওয়ার পরও দুর্ভাগ্যজনক, সাগরের সঙ্গে আমাদের অপরিচয় অশেষ। চেনাজানার এ অভাব বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটা গত দুই বছরে টের পাচ্ছি সাগরতলের সাংবাদিকতা করতে গিয়ে।
আমাদের ক’জনের নাতিদীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। সাগরতলের চিত্রকে মানুষের নিত্যপরিচিত করে তুলতে আমরা বেছে নিয়েছি স্কুবা ডাইভিংয়ের মাধ্যমে সাগরতলের আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্র তুলে আনার কাজ। এক্সপার্ট স্কুবা ডাইভার এসএম আতিকুর রহমান ও বাংলাদেশে আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফির পথিকৃত্ শরীফ সারওয়ার আছেন এ কাজে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ঘাঁটি গেড়ে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা; সব ঋতুতে স্কুবা ডাইভে নামছি দূর সাগরে। আমাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হচ্ছে, একটি আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলকে একটি প্রামাণ্যচিত্র সরবরাহ করা।
উন্নয়নের বিদ্যমান ধারণা, বাংলাদেশের মতো একটি নদীমাতৃক দেশের অভ্যন্তরে সমগ্র জলচক্র ও জলপরিবেশকে যারপরনাই দূষিত করে ছাড়ছে, যার খারাপ প্রভাব পড়ছে সাগরের ওপর, এ চিত্র আমরা তুলে আনছি। একইসঙ্গে এখানে সামুদ্রিক প্রাণ ও পরিবেশ বিনষ্টের দায় কীভাবে উন্নত দেশগুলোর বিদ্যমান ‘সি ফুড নেশা’-এর সঙ্গে যুক্ত, তাও খতিয়ে দেখছি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সাগরের জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ওপরও নজরদারি করছি। পাশাপাশি বাংলাদেশের বেপরোয়া উপকূলীয় ও সামুদ্রিক ট্যুরিজম শিল্প যে টেকসই হবে না, সে দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এই প্রামাণ্যচিত্রেই যাতে উদ্যোগ থেমে না থাকে সে লক্ষ্যে ‘সেভ আওয়ার সি’ নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছি। সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, ডাইভার, গবেষক ও পরিবেশবাদীদের মিলিত এ প্লাটফর্ম জলজ পরিবেশ সুরক্ষায় নিবেদিত থাকবে। সাগরতলের বিপর্যয়ের চিত্র যদি মানুষের সামনে নিত্যদিন হাজির করা যায়, তবে মানুষ সচেতন হবে, ওটুকুই আশা। সাগরের সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে যে মানুষের জীবনমান ও অর্থনীতির নগদ সম্পর্ক রয়েছে, তা আমরা হাতে-কলমে দেখাতে চাই।
এ যাবত্ যতবারই নেমেছি বঙ্গোপসাগরতলে, ততবারই এ বিপুল নীল জলরাশি আমাদের সামনে হাজির করেছে নতুন বিস্ময়, একইসঙ্গে জাগিয়েছে বিপন্নতার বোধ। এ জলেই জীবনের শুরু, এ জলই জীবন বাঁচায়। মহাসমুদ্রের লোনাজল শুধু বিচিত্র জীবনের আধারই নয়, স্থলভাগে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণের জীবন কেমন হবে, তাও নির্ভর করে এর ওপর। বর্তমানে দুনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ উপকূল থেকে ৪০ মাইলের মধ্যে বাস করে। যারা বাস করে দূরে, তারাও সাগরের হাতছানির বাইরে নয়। দুনিয়ার ৮৬ শতাংশেরও বেশি পানীয়জলের মূল উত্স এ সাগর। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান কেমন হবে, অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদরা কেমন থাকবে, তা অনেকাংশেই বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভর করে। স্থলভাগে বৃষ্টির পরিমাণ ও ধরন, অর্থাত্ আবহাওয়া অনেকাংশেই সাগরনির্ভর। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষি, বন ও পরিবেশের সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ মাছের অর্থাত্ মানুষের প্রোটিন-পুষ্টির জোগান দেয় সাগর।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল যেমন আমাজনের চেয়েও অনেক বেশি বিচিত্র প্রাণের বসতি এখনো সাগরতলেই। অথচ প্রায় পুরোটাই অচেনা। ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার ফর মেরিন স্পেসিসের মতে, সাগরের প্রাণবৈচিত্র্যের তিন-চতুর্থাংশও সম্পর্কে মানুষের তেমন জানাশোনা নেই। বিশেষত বাংলাদেশে সাগরের সঙ্গে জানাশোনার এ ঘাটতির নেতিবাচক দিক রয়েছে অনেক। দেশের অভ্যন্তরে পানি দূষণ, সাগরে যথেচ্ছা মাছ শিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, শিকারি প্রজাতিগুলোকে নির্বিচারে নিধন, সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদের বসতি নষ্ট ও সার্বিক দূষণের খারাপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে শুরু করেছে সাগরে। যে ভিডিওচিত্র তুলে আনছি আমরা, তাতে টের পাওয়া যাচ্ছে যে, মাছসহ নানা প্রাণীর নানা প্রজাতি বিপন্ন হচ্ছে, সামুদ্রিক কচ্ছপের নানা প্রজাতি বিপন্নপ্রায়, যে কচ্ছপরা সেই প্রাচীন ডাইনোসর যুগ থেকে এ যাবত্ টিকে ছিল। বিশেষত প্রবালের নানা প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে।
পৃথিবীর মহাসাগরের মাত্র এক শতাংশ জায়গাজুড়ে আছে প্রবাল। বঙ্গোপসাগরেও সে রকমই। খুবই অল্প জায়গায় গড়ে উঠেছে প্রবালপ্রাচীর। কিন্তু এ প্রবালই সমুদ্রে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ প্রাণীর বসতি ও খাবার জোগায়। প্রবাল মূলত ‘পলিপস’, অনুজীব। দেখতে চুনাপাথরের মতো এ প্রবাল জমে জমে পাচীর গড়ে তোলে। আশ্রয় দেয় সাগরতলের নানা উদ্ভিদ ও শৈবালকে। অভয়ারণ্য হয়ে থাকে মাছসহ সব প্রাণীর। এরা অক্সিজেনও জোগায় সমুদ্রে। অথচ নির্বিচার আহরণ ও দূষণের কারণে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ প্রবাল নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে বর্তমান অবস্থা চালু থাকলে। এছাড়া আছে সমুদ্রের ফাইটোপ্লাংকটন। আণুবীক্ষণিক এ উদ্ভিদরা একদিকে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ অক্সিজেন জোগায়, অন্যদিকে এক-তৃতীয়াংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়।
এ সামুদ্রিক পরিবেশ যদি সুরক্ষিত রাখতে না পারি আমরা, তবে মানুষের ইতিহাসের এ সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণের যুগে তা মোটেও সুখকর হবে না। বিশেষত বাংলাদেশের মতো নিচু সমতলভূমির মানুষের জন্য। নিজেদের ক্ষতি যা করার তা করতে আর বেশিকিছু বাকি রাখিনি আমরা। আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার সুযোগ বাদ দিলও নিজস্ব অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমাই দেশের আয়তনের দেড় গুণ, এ যাবত্ মীমাংসিত সীমা কমপক্ষে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার। অথচ দেশে সামুদ্রিক মত্স্য উত্পাদন সে তুলনায় নামমাত্র। ২০১১-১২ সালে মোট সামুদ্রিক মত্স্য উত্পাদন ছিল মাত্র ৫ লাখ ৭৮ হাজার টন, অথচ অভ্যন্তরীণ চাষ করা মাছের উত্পাদন ছিল ১৭ লাখ ২৬ হাজার টন। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে চাষ করা মাছ উত্পাদনে বাংলাদেশ পঞ্চম। অন্যদিকে একই বছরে দেশে কৃষিতে ৪০ লাখ ৪৯ হাজার টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ, উপকূলীয় বাংলাদেশের জন্য কৃষি ও মত্স্য চাষের এ পরিস্থিতি এক বিরাট লজ্জার ব্যাপার।
পললভূমির মধ্যে শিরা-উপশিরার মতো বয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলোর মাঝপথে জীবনবিনাশী বাঁধ চালু থাকতে দিয়েছি আমরা। নদী স্বাভাবিক থাকলে এখানে কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানি দরকার হওয়ার কথা নয়। পললভূমিতে পুষ্টি স্বাভাবিক থাকলে রাসায়নিক বিষও লাগবার কথা নয়। সঠিকভাবে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলভাগ ও সামুদ্রিক উত্স থেকে মত্স্য আহরণ করলে ‘আধুনিক’ মত্স্য খামার করে পানীয়জলের উত্স, কৃষিজমি ও বনাঞ্চল নষ্ট এবং স্থানীয় জাতের মাছ নির্বংশ করার দরকার হয় না। কিন্তু নদীর স্বাস্থ্যরক্ষা না করে বিপরীতে নির্বিচার গভীর নলকূপ বসিয়ে আর্সেনিকের বিষ উঠিয়ে এনেছি ওপরে, জ্বালানি তেল ব্যবহার করে সেচকাজ পর্যন্ত চালাতে হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষিতে। কথিত ‘আধুনিক’ কৃষি ও মত্স্য চাষের নাম করে রাসায়নিক সার ও বিষে ছয়লাব করে দিয়েছি জলজ পরিবেশ। অভ্যন্তরীণ স্রোতের পানি পানের অযোগ্য করে তুলেছি। যে বিষ নদী পথে ছড়িয়ে পড়ছে সাগরেও। এ প্রক্রিয়ার প্রভাব সর্ববিনাশী। পানীয়জলের সংকট, জলজ পরিবেশের দূষণের ফলে স্বাস্থ্যহানি, খাদ্যশস্য ও মাছে বিষ, ম্যানগ্রোভসহ বনাঞ্চল উজাড়, নৌপরিবহনে অচলাবস্থা; এসব ক্ষতির অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হলে তার আকার কত বিশাল হবে অনুমান করা যায়।
এ সংকটের সাক্ষী হয়ে থাকছে বঙ্গোপসাগর। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে, অভ্যন্তরীণ জলদূষণ থেকে এবং রাসায়নিক সারের বিষ থেকে চুইয়ে নামা অবশিষ্টাংশ সাগরকে বাসের অযোগ্য করে তুলছে, যার সাক্ষী প্রচুর শৈবাল। শৈবালের আধিক্যের কারণে উপকূলীয় মহাদেশীয় ঢাল এলাকায় সাগরতলে অক্সিজেন ঘাটতি হচ্ছে। বড় বড় এলাকা নানা প্রজাতির বাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। অভ্যন্তরে জল, কৃষি ও মত্স্য দূষণ বন্ধ করে যদি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পরিকল্পনা নেয়া হয়, তবে এ চক্রের সর্ববিনাশী ক্ষতিকর প্রভাব বন্ধই শুধু নয়, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নিজের ধারাবাহিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বঙ্গোপসাগর।
একইসঙ্গে সাগরকেন্দ্রিক বড় পরিকল্পনার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার। সাগরে পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় পাঁচটি কারণ; দূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলজ প্রাণীর বসতি নষ্ট করা, নির্বিচার মাছ ধরা ও শিকারি প্রজাতি নিধন বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে সফল হতে পারলে মত্স্যসম্পদ, জ্বালানি, সমুদ্রপরিবহন, পর্যটন ও স্কুবা ডাইভিংয়ের মতো নানা অ্যাডভেঞ্চারাস বিনোদনমূলক খাতের আধার হবে সাগর। মত্স্যসম্পদের ক্ষেত্রে প্রথমত. বিভিন্ন প্রজাতির আইডেন্টিফিকেশন ও ডকুমেন্টেশন এবং দ্বিতীয়ত. বিভিন্ন প্রজাতির মজুতের পরিমাণ জরিপ করতে হবে। এর একটিও আমাদের এখানে হয়নি। সেক্ষেত্রে সামুদ্রিক মত্স্যসম্পদের টেকসই আহরণও সম্ভব হবে, যা বর্তমানের চাষ করা মাছের চেয়ে কয়েক গুণ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
লেখকঃ সাংবাদিক,পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মী এবং সমন্বয়ক সেভ আওয়ার সি