শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণিদের জীবনধারাঃ পর্ব ২

শাওন চৌধুরী

পানিতে বসবাসকারী প্রথম মেরুদণ্ডী প্রাণি হচ্ছে উভচর শ্রেণির যাদের আবাস মাটিতেও রয়েছে। সমগ্র পৃথিবীতে এদের প্রায় ৬০০০ প্রজাতি রয়েছে এবন নিত্যনতুন আরো অনেক প্রজাতি আবিস্কার হচ্ছে। যদিও এদের অনেক প্রজাতিই আমাদের অদেখা রয়ে গেছে তারপরেও প্রজননকালে আমরা বেশীরভাগই এদের ডাক শুনে অভ্যস্ত। ডাক শুনেই আমরা বুঝতে পারি যে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ তাদের মিলনসংগী খোঁজার জন্যই এরকম ডাক দিচ্ছে যদিও এমন অনেক উভচর শ্রেণির সদস্যই রয়েছে যারা কিনা চুপচাপ কিংবা লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতে বেশী পছন্দ করে যেমন বিভিন্ন স্যালামান্ডার, নিউটস ইত্যাদি। তারপরেও উভচর শ্রেণির প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে নরম, ভেজা গ্রন্থিময় ত্বক যা কিনা সব সদস্যের মধ্যেই দেখা মেলে, কোন কারণে এই ভেজা ত্বক শুকিয়ে গেলে এদের মৃত্যু সুনিশ্চিত।

৪০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে পানিতে কেবল বিভিন্ন প্রকার মাছই বাস করতো, তখন স্থলবাসী প্রাণি ছিল বিভিন্ন প্রকার পতংগ। ধীরে ধীরে এই মাছের কোন সদস্য স্থলে উঠে বাস শুরু করে এবং এভাবেই উভচর শ্রেণির আগমন ঘটে। কিন্তু পানিতে ও স্থলে জীবনযাপনের মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য তাই তাদের আকার ও গঠনেও অনেক কিছুই আলাদা দেখা মেলে। সুতরাং সবার মনেই প্রশ্ন রয়েছে সেই বিশেষ প্রাণিটির কোথায় দেখা মিলবে যারা কিনা পানি থেকে উঠে এসে ডাঙ্গায় আবাস শুরু করেছিল!!

1

অস্ট্রেলিয়ার উত্তরপূর্বে এমনই এক প্রজাতির অদ্ভুত প্রাণির দেখা মেলে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এসব অঞ্চলের নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে তারপরেও এখানে এরা বাস করে। এরা হচ্ছে Lungfish, পানিতে এদের আবাস হলেও ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়, সমগ্র পৃথিবীতে এদের তিন প্রজাতির দেখা মেলে। আমাদের যেমন দুজোড়া হাত-পা থাকে এদেরও তেমনি দুজোড়া মাংসল পাখনা থাকে যার সাহায্যে এরা চলাফেরা করে। এদের মুখের মধ্যে একপ্রকার থলে জাতীয় অংশ থাকে, নির্দিষ্ট সময় পরপর এরা পানির ওপরে উঠে এসে অক্সিজেন গ্রহণ করে। প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে এদের পূর্বপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিল।

2

অনেকটা এদের মতোনই দেখতে জাপানে একধরণের স্যালামান্ডার পাওয়া যায়। এরা Giant Salamander নামে পরিচিত যারা কিনা লম্বায় প্রায় এক মিটার পর্যন্ত হতে পারে, বর্তমানে প্রাপ্ত লম্বায় সব থেকে বড় উভচর সদস্য। এদেরও ফুসফুস থাকে এবং পানিতে বাস করে তারপরেও এরা কখনো পানি থেকে ডাঙায় উঠে আসেনা। এদের নিজস্ব গুহা থাকে এবং এরা সব সময় ঐ গুহা পাহারা দেয়াতে ব্যস্ত থাকে। যদি কখনো অন্য কোন পুরুষ সদস্য ঐ গুহাতে ঢোকার দুঃসাহস দেখায় তাহলে সে ঐ আগন্তুকের দফারফা করে ছেড়ে দেয়। এদের এরকম আক্রমণাত্মক হবার পেছনে যথেস্ট কারণ রয়েছে। কোন এক সময় কোন স্ত্রী সদস্য এই গুহাতে এসে মিলনে অংশ নিয়েছিল এবং ডিম পেড়েছিল, পরবর্তীতে ঐ ডিমগুলো পুরুষ সদস্যের আমানতে রেখে গেছে। মাছের ডিমের মতোন এদের ডিমেরও কোন আবরণ থাকেনা এবং এগুলো চারপাশের পরিবেশ থেকে আদ্রতা গ্রহণ করেই পরিণত হতে থাকে।

3

Alpine Newt এরও নির্দিষ্ট সীমানা থাকে যার মধ্যে এরা বিভিন্ন স্লাগ ও বিভিন্ন পোকা শিকার করে খেয়ে থাকে, এদের সীমা প্রায় অর্ধেক ইয়ার্ড হয়ে থাকে। শীতকালে এদের আবাসস্থলের চারপাশের পানি বরফ হয়ে যাবার কারণে এরা বরফের নীচে বাস করে এবং আবার বসন্তের আগমনের সাথে সাথে এরা প্রজননে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসময় স্ত্রী সদস্য অনেক ডিম ধারণ করে এবং ডিম পাড়ার কাজে পানিতে যেতে হয়। পানিতে যাবার পরে মাঝে মাঝে পুরুষ সদস্যের সাথে দেখা মেলে। পুরুষ সদস্য যদি মিলনে আগ্রহী হয় তাহলে ফেরোমন নিঃসরণ করতে থাকে এবং সুন্দরভাবে অনবরত লেজ নাড়াতে থাকে। স্ত্রী সদস্য এই ফেরোমনের গন্ধ পায় এবং মুখ দিয়ে স্বাদগ্রহণ করে। তাকে আকৃষ্ট করার পরে পুরুষ সদস্যটি ঐখান থেকে চলে যেতে চায় এবং যাবার পূর্বে শুক্রাণুর গুচ্ছ নিঃসরণ করে। এরপর সে পুরুষ সদস্যটিকে অনুসরণ করে এবং ক্লোয়াকার ছিদ্র দিয়ে ঐ শুক্রাণুর প্যাকেট গ্রহণ করে নেয়। ২-৩ দিন পরেই সে ডিম পাড়া শুরু করে এবং একটা একটা করে পাড়ে। এভাবে সে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ডিম পাড়ে এবং তার ডিমের সংখ্যা মাঝে মাঝে ১০০ ও অতিক্রম করতে পারে।

4

উত্তর অ্যামেরিকার পূর্বদিকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি লম্বা বিভিন্ন প্রজাতির স্যালামান্ডার পাওয়া যায়। বসন্তের শেষদিকে এসব অঞ্চলে বৃষ্টিতে সব ভিজে একাকার হয়ে যায়, এসময় দেখা মেলে Marble Salamander এর। পাতার মধ্যে থেকে বের হয়ে এরা মিলনসংগী খুজতে থাকে। এরা শীতের বেশীরভাগ সময়ই পাতার মধ্যে থেকে সময় পার করে আর নিঃশ্বাস নেয় ভেজা ত্বকের সাহায্যে। এ সময়ে পানিযুক্ত ভূমি এদের জন্য মৃত্যুর আরেক নাম কারণ এরা পানিতে ডুবে মারা যাবে! যদিও এরা পূর্বে বর্ণিত পানিতে থাকা নিউটসদের মতোনই একই উপায়ে মিলনে অংশ নেয়। উত্তেজিত হলে এরা ফেরোমন নিঃসরণ করে যার গন্ধ পেয়ে স্ত্রী সদস্য আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। পুরুষ সদস্য শুক্রাণুর ক্যাপস্যুল নিঃসৃত করে এবং স্ত্রী সদস্য তা গ্রহণ করে নিজের শরীরের ভেতরে নিয়ে নেয়। পরে এরা ডিম পাড়ে এবং অতিরিক্ত সতর্কতার সাথে ঐ ডিম পাহাড়া দিতে থাকে।

অপরদিকে ডিমের ভেতরের অংশ খুবই তাড়াতাড়ি রূপান্তরিত হতে থাকে। চারপাশের পরিবেশ তখন বৃষ্টিমুখর থাকে এবং বাচ্চার উন্নয়নের জন্য পানি অত্যাবশ্যক। তখন মা আর ঐখানে থাকতে পারেনা, দ্রুততার সাথে স্থান পরিত্যাগ করে এবং যথাসময়ে বাচ্চা ডিম ফুটে বের হয়। ডিম ফুটে যা বের হয় তা হচ্ছে ব্যাঙের বাচ্চার মতোন অর্থাৎ এরা হচ্ছে, ট্যাডপোল। ধীরে ধীরে বাচ্চার শরীরের বাইরের দিকে গিলস এর আবির্ভাব ঘটে এরা প্রকৃতপক্ষেই পানিতে বসবাসের উপযোগী। প্রথম দিকে এদের সামনের পা থাকে এবং দিনের মধ্যেই পেছনের পায়েরও আবির্ভাব ঘটে। যতোই এরা বড় হতে থাকে ততোই এদের গিলস ও পানিতে বসবাসের অন্যান্য উপযোগী অন্যান্য অংগের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। এক সময় এরা পরিণত হয়ে যায় এবং চিরকালের জন্য পানি ত্যাগ করে ডাঙায় উঠে আসে।

এগুলো তো হলো এখন মাছ তো আর এমনি এমনি ডাঙায় উঠে আসেনি, এদের এরকম করার পেছনে নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। বলুনতো সেইটা কি হতে পারে!! খাবারের অভাব বোধ করার কারণেই এরা এরকম করে। যখন প্রথম উভচর ডাঙায় উঠে আসে তখন স্থলভাগ ছিল বিভিন্ন পতংগের জলাভূমি। কিন্তু এদের বেশীরভাগ পতংগই উড়তে পারতো যার কারণে এদের ধরা সহজ ছিলনা। এজন্য ধীরে ধীরে এদের মাঝে এসব পতংগ ধরার নানান উপায় আয়ত্ত করতে থাকে এবং শরীরের অনেক অঙ্গের অনেক পরিবর্তন ঘটে।

শিকার ধরার ক্ষেত্রে স্যালামান্ডারের আলোর দ্রুততায় ছুটতে না পারলেও এদের জিহ্বা এক বিশেষ রূপ নিয়েছে। জিহ্বার চারপাশের মাংসপেশিগুলো বিশেষভাবে গঠিত হয় যার কারণে এরা শিকারের ওপরে জিহ্বা ছুড়ে দিয়ে শিকারকে মুখের ভেতরে নিয়ে আসতে পারে। তারপরেও জিহ্বার প্রসারণ ক্ষমতা বেশী না থাকার কারণে এরা খুব দূর থেকে শিকার করতে পারেনা। এদের বেশীরভাগেরই শরীরের তুলনায় জিহ্বা তিন চতুর্থাংশ হয়ে থাকে।

5

উত্তর আমেরিকায় এক ধরণের স্যালামান্ডার পাওয়া যায় এরা আবার অন্য দিক দিয়ে দক্ষ। সোনার খনি খোঁজার জন্য অনেক দিন আগে কিছু লোক এক গর্ত করেছিল যদিও তারা কিছু পায়নি কিন্তু পরবর্তীতে ঐ গর্তটি প্রাণিবিদদের কাছে সোনার চেয়েও মূল্যবান হয়ে ধরা পড়েছিল। এখানে এক ধরণের Slimy Salamander পাওয়া যায়। এই স্যালামান্ডারগুলোর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে এই গুহার থেকে উত্তম জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবেনা এবং এদের আচরণ গবেষণা করে অদ্ভুত কিছু তথ্য্ পাওয়া গেছে।

প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে এদের স্ত্রী সদস্য এই মাইনের প্রায় ৬০০ মিটার নীচে এসে নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নেয়, তারা প্রতিবছর একই স্থানে আসে এবং এভাবে তারা টানা প্রায় ৬-৭ মাস থাকে। সবথেকে মজার বিষয় হচ্ছে, বলতে গেলে এরা এই সময় সম্পূর্ণ না খেয়ে থাকে, এদের লেজে জমে থাকা চর্বির সাহায্যে এরা খাবারের চাহিদা পূরণ করে। সাধারণভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে এই মাইনের এতোটা নীচে কতোটা অন্ধকার হতে পারে! আবার আলোর ব্যবস্থা করলে এদের সাধারণ কার্যকলাপের ব্যঘাত্ত ঘটবে তাই গবেষকেরা তাঁদের ইনফ্রা-রেড ক্যামেরাতে এদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করেছেন। এদের কিছু কিছু সদস্য আবার লেজে পরিমাণ মতোন চর্বি জমা রাখতে পারেনা যার কারণে এরা অন্য সদস্যদের ডিম চুরি করতে চেস্টা করে। স্যালামান্ডার সাধারণত অনেক ভেজা ত্বকের অধিকারী হয়ে থাকে আর যেহেতু তারা পাতার মধ্যে দিয়ে যেয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পতংগ শিকার করতে থাকে তার কারণে এদের আকারের দিক থেকেও অনেক চিকন হয়ে থাকে।

অনেকটা স্যালামান্ডারের মতোনই দেখতে আরেক সদস্য আছে যাদেরকে হঠাত করে দেখলে অনেকেই কেঁচোসদৃশ প্রাণি ভেবে ভূল করে বসতে পারেন কিন্তু হাতে নিয়ে দেখলেই পিঠের দিকে শক্ত মেরুদন্ডের ছোঁয়া পেয়ে আপনার ভূল ভাঙবে। এরা হচ্ছে সিসিলিয়ান। পৃথিবীর প্রায় সকল রেইনফরেস্টে এদের আবাস হলেও এদের দেখা অনেকটাই ভাগ্যের ব্যপারই বলা চলে কারণ এরা দিনের বেশীরভাগ সময়ই গর্তের মধ্যে কাঁটায়। এদের স্ত্রী সদস্যেরা বাচ্চাগুলোকে সবসময় নিজের কাছে আগলে রাখে। এই মায়ের শরীর থেকে এক ধরণের তরল পদার্থের নিঃসরণ হয় যা খেয়েই ঐ বাচ্চাগুলো বেঁচে থাকে। এভাবে এক সপ্তাহে তাদের ভর প্রায় ১০ গুণ বেড়ে যায়। অনেকেই হয়তো ভাবছেন যে শুধুমাত্র এই তরল পদার্থ পান করেই কি এরা বেঁচে থাকে!! একটু পরেই আপনারা উত্তর পেয়ে যাবেন। এসব সদস্যদের মুখে বাচ্চা হাঙ্গরের মতোনই ছোট ছোট হুকের মতোন দাঁত থাকে এরা এই দাঁত দিয়ে তাদের মায়ের শরীরের বাইরের চর্বিযুক্ত ত্বকের আবরণ ছিড়ে খায়। এই আবরণ তিন দিনের মধ্যে পুণরায় জন্মায় এবং এভাবেই এসব সিসিলিয়ান বাচ্চারা বড় হতে থাকে।

বেশীরভাগ উভচরেরই প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে এদের প্রয়োজন মতোন আকারের পা, সময়ের সাথে টিকে থাকার জন্য এদের পায়ের বিবর্তন অনেকভাবেই ঘটেছে যার কারণে এরা এই অঙ্গের সর্বচ্চ ব্যবহার করতে সক্ষম। এদের কোন কোন সদস্য মাটিতে হেটে চলে, কিছু সদস্যে গাছের ডগা বেয়ে চলে, কেও কেও লাফিয়ে চলে আবার কিছু সদস্য এদের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে। এরা পায়ের আঙ্গুলের মাঝে থাকা চামড়ার ওয়েবকে প্যারাশুটের মতোন ব্যবহার করে বাতাসে ভেসে চলে। যাদের ত্বক তুলনামূলক বেশি সিক্ত থাকে তাদেরকে Frog এবং যাদের একটু কম সিক্ত থাকে তাদেরকে Toad বলা হয়ে থাকলেও সবাইই একই গ্রুপে অবস্থিত।  সমগ্র পৃথিবীতে এদের প্রায় ৫৬০০ প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে মাদাগাস্কারে ক্ষুদ্রতম ব্যাঙ পাওয়া যায়, এরা পরিণত অবস্থায় লম্বায় মাত্র এক সেন্টিমিটার হতে পারে। এরা বিভিন্ন পরিবেশে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারে।

ডাঙায় থাকা অবস্থায় এরা একে অন্যের সাথে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন ভাবে ডাকে। এদের মুখের নীচের অংশে এক ধরণের থলেসদৃশ অংশ থাকে যার সাহায্যেই এরা শব্দ উতপন্ন করে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে এক ধরণের ব্যাঙ পাওয়া যায় যাদের ডাক কিনা কয়েক মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। এরা Painted Reed Frog নামে পরিচিত, আকারের অনুপাতে এরাই সব থেকে উচ্চস্বরে ডাকতে পারে। এদের স্ত্রী সদস্যেরা কে কতো উচ্চস্বরে ডাকে তা দেখে নয় বরং কে কতোটা জোরে এবং অনবরত কতো সময় ধরে ডাকতে পারে তা দেখেই মিলনসংগী নির্ধারণ করে। এভাবে সংগী নির্ধারণ করার পেছনে যথেস্ট কারণ রয়েছে… অন্য কোন কাজ করার তুলনায় এভাবে ডাকতে প্রায় বিশগুণ বেশি শক্তির প্রয়োজন হয় যা দ্বারা সহজেই স্ত্রী সদস্যেরা সহজেই শক্তিশালী পুরুষ বাছাই করতে পারে।

6

পানামাতে একধরণের দুস্প্রাপ্য ব্যাঙ পাওয়া যায়, এরা Golden Frog নামে পরিচিত। এরা ডাকতে পারলেও খুব জোরে ডাকতে পারেনা। এরা নদীর পাশে বসে ডাকতে থাকে এবং এভাবে ডাকার মাধ্যমেই নিজেদের সীমানার জানান দেয়। যদি কখনো কোন পুরুষ সদস্য আরেক পুরুষের সীমানাতে ঢুকে পড়ে তাহলে যার সীমানা সে প্রথমে হাত হাত দুলিয়ে ইশারা দেয় যা দেখে অনেকটাই মনেহয় যে, ‘এটা আমার সীমানা, এখান থেকে চলে যাও!’ এরপরেও যদি নতুন আগন্তুক ঐ স্থান ত্যাগ না করে তাহলে আবার একই ইশারার পুনরাবৃত্তি ঘটায়, এরপরেও স্থান ত্যাগ না করলে এদের মধ্যে লড়াই হয় এবং যে জিতবে, ঐ সীমানার ভার তার ওপরে বর্তাবে। পরবর্তীতে সে ঐখানে থেকে স্ত্রী সদস্যের জন্য অপেক্ষারত থাকবে এবং একসময় তার আগমন ঘটবে। মজার বিষয় হচ্ছে যে, স্ত্রী সদস্য পুরুষ সদস্যদের তুলনায় আকারে কয়েকগুণ বড় হয়। অনেকসময় যখন এরা মিলনরত থাকে তখন অন্য পুরুষের আগমণ ঘটতে পারে। এদের ত্বক অনেক বিষাক্ত হয় যার কারণে এরা অনেক শিকারি প্রাণির হাত থেকে রক্ষা পায়।

7

এমন অনেক ব্যাঙ রয়েছে যারা শিকারের হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় নেয়, এরা প্রকৃতির সাথে এমনভাবে মিশে থাকে যে হঠাত করে দেখে এদেরকে সনাক্ত করা খুবই কঠিন কাজ। South American Red Eyed Tree Frog এমনই এক প্রকার ব্যাঙ। এদের গায়ের রঙ এমন যে এরা সহজেই গাছের পাতার সাথে মিশে যেতে পারে। এরা পানির ওপরে কোন গাছের পাতার সাথে এদের ডিমকে যুক্ত করে রাখে যা দেখতে অনেকটাই জেলীর মতোন। এদের রূপান্তর অনেক তাড়াতাড়ি হয় এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই এরা ট্যাডপোলে পরিণত হয়। এরপরে ঐ জেলীর আবরণ তরলে পরিণত হয় এবং এরা পানিতে পড়ে। এদের মধ্যে অনেক সদস্যই বাঁচতে পারেনা কারণ কিছু সদস্য জেলী ভেদ করে বাইরে আসতে পারেনা আবার কিছু সদস্য অন্য পতংগের শিকারে পরিণত হয়। বোলতার মতোন কিছু পতংগ এসব ট্যাডপোলকে ধরে নিজেদের বাচ্চার খাবারের জন্য নিয়ে যায়, জেলীর ভেতর থেকে বের না হবার কারণে এদের কিছুই করার থাকেনা। কিন্তু এদেরও বাঁচার জন্য উপায় আছে, যেহেতু এরা জেলীর আবরণ ভেদ করে বাইরে বের হতে পারেনা এজন্য যখনি ঐ পতংগটি জেলীর অংশে কামড় দিয়ে তাদেরকে বের করতে যাবে তখনি তারা লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে। এই সংকেত খুবই দ্রুত অন্যান্য ট্যাডপোলের কাছেও ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা খুবই দ্রুততার সাথে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। এসব ট্যাডপোলের লেজ পরিণত না হলেও এরা পাতার নিচের দিকে যুক্ত থেকে ভেসে থাকতে পারে। প্রকৃতি কতোই না রোমাঞ্চকর!

8

এরাতো ডিম পেরে রেখে চলে যায় আবার এমন অনেক ব্যাঙও প্রকৃতিতে আছে যারা কিনা সর্বদা ট্যাডপোলকে আগলে রাখে। এমন একপ্রকার ব্যাঙ হচ্ছে, Giant African Bull Frog, এরা আকারে অনেকটাই ফুটবলের মতোন। এরা এদের ট্যাডপোলকে একটা বড় পুকুরের পাশে ছোট নার্সারি পুল বানিয়ে ঐখানে বাচ্চাগুলোকে রাখে। এখানে রাখার প্রধান কারণ হচ্ছে বড় ধরণের কোন শিকারের হাত থেকে ট্যাডপোলগুলোকে রক্ষা করা। কিন্তু এখানে থাকার অসুবিধাও রয়েছে। বেশী গরম পড়লে ঐ পুল শুকিয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এরকম হতে থাকে পুরুষ ব্যাঙ তার বাচ্চাদের জন্য একটা ড্রেন কেটে দেয় এবং পথ দেখিয়ে বড় নার্সারিতে নিয়ে যায়। এভাবেই ট্যাডপোলগুলো আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়।

9

দক্ষিণ অ্যামেরিকার রেইনফরেস্টগুলোতে অনেক বড় বড় গাছ পাওয়া যায় আর এখানে অনবরত বৃষ্টি হতে থাকে। এতো বৃষ্টির কারণে গাছের পাতার মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্থানে পানি জমে থাকতে দেখা যায়। এখানে Poison Arrow Frog  এর পুরুষ সদস্য তার পিঠে করে ট্যাডপোল নিয়ে ঐসব ছোট পুলে বাচ্চাকে রেখে আসে কারণ এইসব পুল ঐ বাচ্চাদের জন্য অনেক উপযোগী। এদের ৬-৭টা বাচ্চাও থাকতে পারে, প্রত্যেকের জন্যই এমন ক্ষুদ্র পুলের প্রয়োজন পড়ে। মাঝে মাঝেই ঐসব স্থানে যেয়ে পুরুষ সদস্যটি তার বাচ্চাদের খোজ নেয়, কখনো যদি কোন বাচ্চা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে তাহলে ঐ বাবার পায়ে ঘসা দিয়ে কিংবা শরীর ঝাঁকানি দিয়ে জানান দেয়। কিন্তু এরা তাদের বাচ্চাকে খাওয়ানোর মতোন কিছু পায়না যার কারণে বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য অবশ্যই একটা স্ত্রী সদস্যকে খুঁজে বের করতে হয়। এজন্য সে অনবরত ডাকতে থাকে এবং যখন পেয়ে যায় তখন নিজে পথ দেখিয়ে তাকে নিয়ে আসে কারণ সেই বাবা ছাড়া অন্য কেওই ঐ স্থান চেনে না। ট্যাডপোলের পুলের নিকটে এসে আবার পুরুষটি স্ত্রীকে ঐ বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য আহবান করে কিন্তু যদি কখনো স্ত্রী সদস্য ঐ ডাকের অর্থ না বুঝতে পারে তাহলে পানিতে নেমে বোঝার চেস্টা করে এবং অতঃপর সে অনিষিক্ত ডিম নিঃসৃত করে পুল থেকে উঠে আসে, এভাবেই তার বাচ্চাকে রক্ষা করে। পুল থেকে উঠে আসার পরে পুরুষ সদস্যটি স্ত্রী সদস্যকে জড়িয়ে ধরে রাখে, এ যেন আদরের সাথে বুকে টেনে নেয়া!

10

অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণপূর্ব দিকে কিছু রেইনফরেস্ট দেখতে পাওয়া যায়। এখানে এক ধরণের ব্যাঙ আছে যারা কিনা অনেকগুলো ডিম একত্রে পাতার ওপরে আঠাযুক্ত পদার্থ দিয়ে যুক্ত রাখে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের না হওয়া পর্যন্ত পুরুষ সদস্য অপেক্ষা করে, এভাবে তার ১০-১২ দিন অপেক্ষা করতে হয়। পরবর্তীতে যখন সে বুঝতে পারে যে ডিম ট্যাডপোলে পরিণত হয়েছে তখনি সে ঐ ট্যাডপোলগুলোর ওপরে আসতে করে তার গ্রন্থিময় ত্বক রাখে যাতে করে তার ত্বকের ঘষায় ডিমের শক্ত আবরণ ভেদ করে ট্যাডপোলগুলো বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে! এসব পুরুষ সদস্যদের শরীরে এক ধরণের থলে থাকে, ট্যাডপোল বাইরে বেরিয়ে আসার পরে তাদের মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতা হয় যে কে আগে ঐ থলেতে প্রবেশ করতে পারে! এভাবে ঐ পুরুষ সদস্যটি তার থলেতে সর্বাধিক পরিমাণ ট্যাডপোল সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এভাবে সে অনেকদিন অপেক্ষা করে। কোন এক রাত্রে এদের স্বভাবের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে, ঐদিন দেখা যায় বাচ্চা ঐ থলে থেকে বের হচ্ছে। ট্যাডপোল থেকে বাচ্চাতে পরিণত হবার দশাগুলো ঐ বাবার সিক্ত থলের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। এরা Marsupial Frog নামে পরিচিত।

11দক্ষিণ আফ্রিকাতে এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে বছরে মাত্র ২বার বৃষ্টি হয় এবং তাও অনেক কম সময়ের জন্য। অনেক ব্যাঙ মাসের পর মাস এই কাঙ্ক্ষিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করে এবং মাটির নিচ থেকে বের হয়ে আসে। মাটির নিচে অনেকদিন থাকার কারণে এরা প্রায় অনাহারেই থাকে এরজন্য ওপরে উঠে আসার সাথে সাথে এরা খাবারের জন্য পাগল হয়ে যায়। রাত হবার সাথে সাথেই পুরুষের ডাকাডাকি শুরু হয়ে যায় এবং এই ডাক শুনে স্ত্রী সদস্যদের আগমন ঘটে। পুরুষ সদস্যের তুলনায় স্ত্রী সদস্য এতোটাই মোটা যে, পুরুষ ব্যাঙগুলো ভাল করে জড়িয়ে ধরেও রাখতে পারেনা। যার কারণে এরা এদের তলদেশ দিয়ে এক ধরণের আঠা উৎপন্ন করে যা দিয়ে এরা স্ত্রী সদস্যদের সাথে আটকে থাকে। পরে তারা দুজনে গর্ত করে মাটির নিচে চলে যায় এবং ঐখানেই স্ত্রী সদস্য ডিম পাড়ে, এভাবেই বছরের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পুরুষ সদস্যদের মাটির ওপরের সময়কাল শেষ হয়। মাটির নিচের এই গর্তে ট্যাডপোলদের জন্য নার্সারি থাকে যেখানে এরা বড় হতে পারে। এভাবে আস্তে আস্তে এরা বড় হতে থাকে এবং আকাশে মেঘের ঘনঘটা হয়ে আবারো একদিন বৃষ্টি নেমে আসে, এসব ব্যাঙ ঐ সময়ের জন্যই অপেক্ষারত ছিল এবং বৃষ্টি হবার সাথে সাথেই এরা গর্ত থেকে বাইরে চলে আসে। এসময় মা ব্যাঙ তার সন্তানদের পথ দেখায়। এরা Reinfrog নামে পরিচিত।

অস্ট্রেলিয়াতেও এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে যেখানে কোন কোন বছরে বৃষ্টি একদম হয়না বললেই চলে, সাধারণত মরুভূমি অঞ্চলে এমনটা ঘটে। এখানেও কিছু ব্যাঙ পাওয়া যায় যারা কিনা এক ফোটা বৃষ্টির জন্য সারা বছর অপেক্ষারত থাকে। বৃষ্টি হওয়া মাত্রই এরা গর্ত থেকে বের হয়ে খাওয়া শুরু করে এবং যদি সময় পায় তাহলে প্রজননে লিপ্ত হয়, সব কাজই পরের দিনের সূর্য ওঠার আগে করতে হয়। সকালে সূর্যের তাপ এতোটা বেড়ে যায় যে, সারারাত অঝোরে বৃষ্টি হলেও ঐ পানি শুকাতে খুব একটা সময় লাগেনা, তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি হয়ে যায়। এ সময়ে এসব ব্যাঙ আবার গর্ত করে সেখানে ঢুকে যায়। এভাবেই এদের সারা বছরের কার্যকলাপের পরিসমাপ্তি ঘটে।

Check Also

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র: নদী, নিরাপদ পানি ও মানুষের গল্প

দূষণের এই চিত্র শুধু পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের না, সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নদীরই। কোরোনাকালীন এই দূর্যোগে দূষণমুক্ত নদী হতে পারতো দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপদ পানির অন্যতম উৎস। আমরাই দূষণের মাধ্যমে মানুষকে অন্য উৎসের দিকে ঝুকতে বাধ্য করেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক দলের চমৎকার আবিষ্কারঃ শৈবাল থেকে ন্যানো-ফিল্টার

লেনা আলফি সম্প্রতি শৈবাল থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ ন্যানো ফিল্টার তৈরি করে সারাবিশ্বে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *