এ.সি লাগাবেন, নাকি গাছ!!

ফারজানা হালিম নির্জন 

হে মহাজীবন,দাও ফিরে সে অরণ্য,লও এ নগর…
দীর্ঘ যানজটে বসে গরমে যখন পাগলপ্রায় অবস্থা,তখন এই পংক্তি দুটো কি মনের ভুলেও হাতড়াননি কখনো? অরণ্য ফিরে পাওয়ার এতো আকূলতা কেন আমাদের মাঝে? নগরবাসীর কাছে ষড়ঋতুর একটি ঋতু যেন প্রায় মাথা নীচু করে সব অপমান,গ্লানি সহ্য করে নিচ্ছে দিন কে দিন। হারাতে বসেছে তার নিজ ভূবনের ঐতিহ্য। কোথায় গেলো স্কুলের সেই বিখ্যাত গ্রীষ্মের ছুটির আমেজ? আম-কাঁঠালের দাওয়াতে মামা-বাড়ি যাওয়ার নিমন্ত্রণ-পত্রগুলো যেন গরমের তীব্রতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে অনেক কাল আগেই। বাঙ্গালীর ষড়ঋতুর উৎসব অবশিষ্ট আছে ক’জন কবির কবিতায়,কিংবা কোনো ঔপন্যাসিকের উপন্যাসের ছেঁড়াপাতায়। আধুনিক জীবনে আমরা এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি যে গ্রাম এখন আমাদের কাছে গাজীপুরের কোনো কৃত্রিম পিকনিক স্পট অথবা বাগানবাড়ির সমকক্ষ ছাড়া আর কিছুইনা। সেখানে গেলেও তো দু’চারদিন নিরিবিলি সময় কাটানো যাবে। আর যাই বলুন না কেন,সেখানে এয়ার কন্ডিশনার তো আছে ! এই গরমে এয়ার কন্ডিশনার ছাড়া ছেলে মেয়েরা গ্রামে গিয়ে থাকবে কিভাবে? ফেলে রাখুন তো ঐতিহ্য ! আগে তো বাঁচতে হবে। শহরের ফলের দোকানে কত আম-কাঁঠাল পঁচে নষ্ট হয়! গ্রাম কেন?airconunitsRED

এমনিভাবে নিজেদের জীবনকে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছি আমরা। গ্রীষ্মের ভয়াবহতার রূপ দেখতে দেখতে আর সেই সাথে ঋতু কে গালি গালাজ করেই ক্ষান্ত হই অবশেষে। সমাধান গিয়ে ঠেকেছে একটা এয়ার-কন্ডিশনারে। কখনো কি ভেবে দেখেছেন, ছেলে ভুলানোর মত এই যন্ত্রটি উপকারের পেছনে কতটা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছে স্বয়ং আপনাকেই?

এয়ার-কন্ডিশনারের কার্যকৌশল সহজভাবে বোঝানোর জন্য একটা চরণই যথেষ্ট । ভেতরের বাতাসকে মেশিনের মাধ্যমে স্থানান্তর করে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া। কল-কব্জার বিবরণীতে না গিয়ে সহজভাবে হিসেবটা কষুন। ঘরের ভেতর যখন কয়েক মিনিটের মাথায় কৃত্রিম হিম শীতল আবহাওয়া তৈরী হচ্ছে,তখন গরম বাতাস টা যাচ্ছে কোথায়? উত্তরটা খুব সহজ। বাড়ির বাইরে। সাময়িক সুখে মগ্ন হয়ে হয়তো আরাম বোধ হচ্ছে,কিন্তু কিছু সময় পর ক্ষতিটা যে আমারই হবে,তা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমরা?

“কৃত্রিম” শব্দটি যেকোনো স্থানেই বেশ নড়বড়ে সত্যি। দৈনন্দিন তাপমাত্রা যত বেশিই হোক না কেন,স্বাভাবিকতা থেকে বেরিয়ে যখন হুট করে এ.সি যুক্ত ঘরে প্রবেশ করবেন,তা কিন্তু শরীর খুব সহজে গ্রহণ করতে পারেনা। গুরুজনদের কথাই ঘুরে ফিরে আসে। বাইরে থেকে এসে সাথে সাথে যেমন ঠান্ডা পানি খাওয়া উচিত না,ব্যাপারটা ঠিক তেমনই। তাছাড়া এ.সি চালু অবস্থায় যে পরিমাণ গরম বাতাস আরো গরম করে বাইরে বের করা হচ্ছে,তা আপনার বাড়ির দেয়ালকে সবার আগে গরম করে দিচ্ছে কয়েক গুণ বেশি পরিমাণে। এছাড়া প্রকৃতিতে তো তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করছেই আপনমনে। তাই অস্বস্তিবোধ যেন আমাদের কাটতেই চায়না। তবু এ.সি যুক্ত ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র আগুনের পিন্ডে ঝাপিয়ে পরার পর মনে হয়; ইশ,পুরো শহরটাতে যদি সেন্ট্রাল এ.সি লাগানোর ব্যাবস্থা করা যেতো !
সুখের পরিধি অনেক বড়,কিন্তু কৃত্রিম সুখে কি আসলেই সুখী হওয়া যায় শেষ পর্যন্ত ?bacteria

কিছু কিছু এয়ার কন্ডিশনারে আবার গ্রীন হাউস গ্যাস, HFC ব্যাবহার করা হয়। HFC গ্যাস,CFC গ্যাসের মত এতোটা ক্ষতিকর না হলেও একেবারে অবহেলায় ফেলেও দেয়া যায়না কিন্তু! পুরো বিশ্বে এতো তোলপাড় বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে,তাহলে ভাবতে পারছেন কি,এই গ্যাস তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কী পরিমাণে তরাণ্বিত করছে! আর ছত্রাকের কথা তো বাদই পড়ে গেলো। এ.সি যন্ত্রটির ভেতরে এক ধরণের ছত্রাক বাসা বাঁধে। ভেতরের ঘূর্ণায়মান পাখা,আর একই সাথে তীব্র গরম এবং তীব্র ঠান্ডার কারণে ছত্রাক তার অনুকূল পরিবেশ পেয়ে যায়। তাই এ.সি তার কার্যক্ষমতা শুরু করা মাত্রই ঠান্ডা বাতাসের সাথে সাথে সেসব ছত্রাকও ছড়িয়ে পড়ে পুরো ঘরটিতে। পুরো ঘরে থাকি আমরা,কাজেই আমাদের শরীরে প্রবেশাধিকার পেয়ে যায় তারা বিনা অনুমতিতেই !খুসখুসে কাশি থেকে শুরু করে মারাত্মক সব রোগের জন্ম দেই আমরা নিজের অজান্তেই।

এ.সি নিয়ে আর কিছু বলতে চাচ্ছিনা। এবার একটু শান্তির কথা বলি। একটু ভাবুন, বিশাল এক অরণ্যের মাঝে আপনি আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। যেদিকে তাকাচ্ছেন,সেদিকেই ডাল-পালা ছড়িয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সবুজ এক ক্যানভাস। রোদের লুকোচুরি খেলা পাতার ফাঁকে ফাঁকে। একটু মৃদু ঠান্ডা বাতাস আপনাকে একটু পর পর নিবিড় মমতায় পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। main_earthday_0320

এবার চলুন একটু বৈজ্ঞানিকভাবে ভাবি। আপনি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ছাড়ছেন কার্বন-ডাই-অক্সাইড। আর সবুজ গাছগুলো আনন্দের সাথে সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিজের ভেতর নিয়ে নিচ্ছে। আপনার কাছ থেকে নেয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড দিয়ে তারা মনের সুখে খাবার তৈরী করছে,বেড়ে উঠছে আরো এক ধাপ। সেই সাথে তাদের ভেতর তৈরী হচ্ছে অতিরিক্ত অক্সিজেন। বন্ধুত্বের উপহার স্বরূপ সেই অক্সিজেন দিয়ে দিচ্ছে আপনাকে। আপনি প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিচ্ছেন। গড়ে উঠছে কত শত বন্ধুত্ব !

আমাদের শহরটাকে কি এরকম করা সম্ভব নয়? আমরা নিজেরা না করলে আর কারা করবে ! গাছ তো নিরুপায়,তারা তো আমাদের সাহায্য ছাড়া নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারছে না। আমরা যদি বন্ধু ও নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটু সচেতন না হই, তাহলে কিভাবে বাঁচাবো এই পৃথিবীটাকে ? শুধু সভা-সেমিনারেই কি কাজ হয়ে যাবে,যদি নিজেদের বিবেক জেগে না ওঠে? একটু জাগিয়ে তুলুন বিবেক মহাশয়কে। নিজেকে দিয়েই শুরু করুন সবার আগে। বাড়ির আঙ্গিনা দিয়েই শুরু করুন না গাছ লাগানো! আপনাকে দেখে শিখবে আরেকজন। তাকে দেখে শিখবে আরেকজন। এভাবেই একদিন সবুজে সবুজে শান্তিময় বার্তা ছড়িয়ে পড়বে পুরো বিশ্বে। এ.সি র কৃত্রিম ঠান্ডা স্পর্শে আর কতদিন? সবুজের কাছেইতো ছায়া মেলে শেষমেশ…

Check Also

আলোকচিত্রী আফজাল করিমের একক আলোক চিত্র প্রদর্শনী শুরু আজ

ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে আফজাল করিমের ফটোগ্রাফির একক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে আজ।। বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য বিশ্ববাসিকে সোচ্চার করে তোলাই এ প্রদর্শনী মূল উদ্দেশ্য ।

প্লাস্টিকের সাগর চাই না !

বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ প্রবাল নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে বর্তমান অবস্থা চালু থাকলে। এছাড়া আছে সমুদ্রের ফাইটোপ্লাংকটন। আণুবীক্ষণিক এ উদ্ভিদরা একদিকে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ অক্সিজেন জোগায়, অন্যদিকে এক-তৃতীয়াংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *