কোন দিকে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি ??

 তানভীর হোসেন

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে গ্রামীন অঞ্চলের প্রায় ৮০% মানুষই কৃষি কাজের সাথে জড়িত। দেশে প্রায় ৭৭% চাষযোগ্য জমিই কৃষি কাজের জন্য মধ্যম ধরনের উপযোগী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের কৃষি জমির উপর হুমকী হয়ে আসছে লবনাক্ততা। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি জমিই লবনাক্ততার প্রধান শিকার। সম্প্রতি উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে অতিরিক্ত পরিমানে লবনাক্ততার আলামত পাওয়া যাচ্ছে যা সংশ্লিষ্ট মাটির কৃষি উপযোগিতা হ্রাস করছে। দেশের বিশেষ করে উপকূলীয় ১৯ জেলার ১৩৩ টি উপজেলার কৃষি জমিতে লবনাক্ততার মাত্রা অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষকরা লবনাক্ততা বৃদ্ধির প্রধান দুইট কারন নির্দেশ করেছেন যেগুলো সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বিগত ১৮৮০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৫৩° ফারেনহাইট(আইপিসিসি) এবং সমূদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ থেকে ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত। সমূদ্র পৃষ্ঠের এই উচ্চতা বৃদ্ধির কারনে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে সমুদ্রের লবনাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং ভুগর্ভস্থ পানিতেও লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

coastal4

এক্ষেত্রে প্রথমে বৈশ্বিক উষ্ণতা তথা জলবায়ুর পরিবর্তনের উপর দৃষ্টি দেয়া যাক। ইন্টারগভর্ণমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ(আইপিসিসি) এর তথ্যমতে, চলমান শতাব্দীতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বিগত ১০০০০ বছরের চেয়েও দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ১৯৮৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত রংপুর স্টেশনে পাওয়া তথ্যমতে বার্ষিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ০.০৩৫°সেলসিয়াস এবং ০.০২৭°সেলসিয়াস। একইভাবে ১৯৭১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বগূড়া স্টেশনে পাওয়া তথ্যমতে বার্ষিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ০.০০৮°সেলসিয়াস থেকে ০.০০৩°সেলসিয়াস। এই উষ্ণতা বৃদ্ধি উপকুলীয় অঞ্চলের মাটি থেকে পানির বাষ্পায়ন বৃদ্ধি করছে যার ফলে মাটিতে লবনাক্ততার আনুপাতিক মাত্রা চরমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবনাক্ততা বৃদ্ধি কৃষি জমির ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস করছে। জিওফিজিক্যাল ফ্লুইড ডায়নামিক ল্যাবরেটরি(জিএফডিএল) মডেলে অনুযায়ী, প্রতি ৪°সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ধান ও গমের ফলন ১৯৯০ সালের মৌলীক উৎপাদন সমীক্ষার তুলনায় যথাক্রমে ১৭ শতাংশ ও ৬১ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। আইপিসিসি’র ভ্যাষ্যমতে খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের উপর এই প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। তার উপর বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে জলবায়ুর যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তার ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলসমূহের উপর আঘাত হানছে। এতে জলোচ্ছাসের মাধ্যমে সমূদ্রের লবনাক্ত পানি আভ্যন্তরীন কৃষি জমিতে চলে আসছে যা উক্ত কৃষি জমির লবনাক্ততা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা ব্যহত করছে যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায় সিডর এবং আইলা। প্রলয়ংকরী সাইক্লোন আইলার পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় প্রায় দুই বছর ধরে লবনাক্ত পানি জমে ছিল এবং এখনও আছে এবং এর ফলে উক্ত অঞ্চলের মাটি ও পানির লবনাক্ততা মারাত্নকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে যা স্বাভাবিকভাবেই কৃষির উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

Sea Level Rise in India

সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে লবনাক্ত পানির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্ক মেটেওরোলজিকাল রিসার্চ কাউন্সিল(এসএমআরসি) গত ২২ বছর ধরে বাংলাদেশের তিনটি উপকূলীয় কেন্দ্রে গবেষনা চালিয়ে দেখায় যে গত ১০০ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার বৈশ্বিক হারের তুলনায় কয়েকগুন বেশি। তিনটি কেন্দ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির হার থেকে তা ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়।

উপকূলীয় কেন্দ্র অঞ্চল হার(মিমি/বছর)
হিরনপয়েন্ট পশিম ৪.০
চরগঙ্গা মধ্য ৬.০
কক্সবাজার পূর্ব ৭.৮

সূত্রঃ এসএমআরসি

জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি ১৯৮৯ সালে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১.৫ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে যার ফলে ১৬ শতাংশ ভূমি সমূদ্রের পানিতে প্লাবিত হবে। আবার বিশ্বব্যাংক ২০০০ সালে এক গবেষনালব্ধ তথ্য থেকে উদৃত করে ২০২০, ২০৫০ ও ২১০০ সাল নাগাদ সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে যথাক্রমে ১০ সেমি, ২৫ সেমি ও ১ মিটার যা যথাক্রমে ২%, ৫% ও ১৭.৫% জমি প্লাবিত করবে। এভাবে সমূদ্রের লবনাক্ত পানি দ্বারা প্লাবিত জমির কৃষি উৎপাদনক্ষমতা চরমভাবে হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন সংস্থা(বিএডিসি) এর তথ্যমতে, সাতক্ষীরা জেলার তালা ও দেবহাটা উপজেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রাপ্ত লবনাক্ততার মাত্রা ৫০০০ মাইক্রোসিমেন্স/বর্গসেন্টিমিটার যা সমূদ্রের পানির উত্তরমূখী অগ্রগামীতা নির্দেশ করে। এসকল তথ্য থেকে প্রতিয়মান হয় আগামী ৩০ বছরে ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক লবনাক্ততা পরিলক্ষিত হবে যা উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থার উপর মারাত্নক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

উপরোক্ত তথ্যসমূহ পড়ে আতঙ্কগ্রস্ত হলেও তা নিয়ন্ত্রন করা মানুষের পক্ষে আদতে সম্ভবপর নয় কারণ যেসকল কারণ সমূহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা বৈশ্বিক কার্যক্রমের ফল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের উপর যে কিরূপ প্রভাব পড়ছে তা হয়তো আজো বিশ্ববাসী বুঝতে পারছেনা কিন্তু খুব শীঘ্রই আমাদের উপর তা অভিশাপরূপে বর্ষিত হবে তখন হয়ত বিশ্ববাসীর চেয়ে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষির জন্য বিকল্প ব্যবস্থা খুব শীঘ্রই গ্রহণ করা উচিত অন্যথায় একটি বিরাট জনগোষ্ঠী সাংঘাতিকভাবে দুর্ভিক্ষ কবলিত হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading