পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত "কে-টু" জয়ের পেছনের তিক্ত ইতিহাস!- পর্ব ১

দেবাশিষ বল

কে-টু, পাকিস্তানের কারাকোরাম মাউন্টেইন রেঞ্জে অবস্থিত পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত। ২৮,২৫০ ফুট আকাশছোঁয়া উচ্চতার এই চূড়াকে পৃথিবীর সুউচচ পর্বতগুলোর মধ্যে আরোহণের জন্য সবচেয়ে কঠিন বলে বিবেচনা করা হয়। চরম অনিশ্চিত আবহাওয়া, বিপদজনক খাড়া পাথুরে দেয়াল, যখন তখন নেমে আসা তুষারধস, প্রচণ্ড অক্সিজেন-স্বল্পতা, সবকিছু মিলিয়ে কে-টু আরোহণ করা যেকোনো পর্বতারোহীর জন্যই বিশাল এক অর্জন। ঠিক একারণেই যুগ যুগ ধরে প্রতিবছর স্বপ্নের পিছু নিয়ে এখানে ছুটে আসে অসীম সাহসী কিছু মানুষ। এদের কেউ কেউ স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় নেয়ার সুযোগ পায়, কেউ কেউ এখানেই চিরতরে হারিয়ে যায়। এর দুর্গমতা ও পর্বতারোহীদের স্থায়ীভাবে এখানেই রেখে দেয়ার রেকর্ডের (!) কারণে এর নাম হয়ে যায় ‘কিলার মাউন্টেইন’ , ‘স্যাভেজ মাউন্টেইন’, ‘মাউন্টেইন অব দ্যা মাউন্টেইন্স’ ইত্যাদি।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের সফল ইটালিয়ান এক্সপিডিশনের আগ পর্যন্ত মোট পাঁচটি দল এই পর্বতে অভিযান চালায়। তার মধ্যে আমেরিকানদের ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৫৩ সালের অভিযান তিনটিই মোটামুটি উল্লেখযোগ্য উচ্চতায় উঠতে সক্ষম হয়।

১৯৫৪ সালের ৩১শে জুলাই ইটালিয়ান টিমের সদস্য ‘আচিলি কম্পেগননি’ ও ‘লিনো লাচেডেলি’ প্রথমবারের মতো কে-টু জয় করেন। তখন থেকেই ইটালিতে এটি একটি গৌরবময় জাতীয় অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু কে-টু জয়ের এই গৌরবময় ইতিহাসের পেছনে লুকিয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকতার এক করুণ ও শ্বাসরুদ্ধকর অধ্যায়।

আজকে আমরা এমনই এক কাহিনী শুনবো যা পরবর্তীতে একজন আরোহীর, বলা ভালো পর্বতারোহণের পুরো ইতিহাসটাই পাল্টে দিয়েছিলো।

(‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন’ -এ প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের চুম্বক অংশ অবলম্বনে)

—————————————————

জুলাই ৩০, ১৯৫৪।

আকাশছোঁয়া অনিঃশেষ বরফের রাজ্যে অন্ধকার নেমে আসতেই ক্লান্ত পর্বতারোহী তার মাথার উপরের ঢালটায় কী যেন খুঁজলো। “লিনো! আচিলি!! কোথায় তোমরা?” চিৎকার করে ডেকে উঠলো সে। কিন্তু ওদের হয়ে কেবল নীরবতাই উত্তর দিলো। সারাদিনের একটানা লোড ফেরি করার অমানুষিক পরিশ্রমের শেষে ওয়াল্টার বোনাত্তি ও তার সঙ্গী অকুতোভয় হানযা পোর্টার আমির মেহেদি পৃথিবীর ২য় সর্বোচ্চ পর্বত পাকিস্তানের কে-টু এর বুকে ২৬,৫৭৫ ফুট পর্যন্ত উঠে এসেছে।

এটি সেই সময় যখন পৃথিবীর বুকে পর্বতারোহণের পরম আরাধ্য পুরস্কার কে-টু এর চূড়া সুসংঘটিত একটা ইটালিয়ান টিমের প্রায় হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, প্রতিনিয়ত যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ঠিক আগের বছরটাতেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্টে প্রথমবারের মতো মানুষের পা পড়েছে। এবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতের পালা।

জুলাই মাসের সেই সকালবেলায় ইটালিয়ান টিমের ক্লাইম্বিং লিডার ৪০ বছর বয়সী আচিলি কম্পেগননি এবং তার সহঅভিযাত্রী ২৯ বছর বয়সী লিনো লাচেডেলি কে-টু এর সামিট পুশের উদ্দেশে ৯ নম্বর ক্যাম্পে উঠে আসে। ওয়াল্টার বোনাত্তি যদিও পুরো ইটালিয়ান টিমের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী ছিলেন কিন্তু আল্পসের বুকে নতুন নতুন রুটে আরোহণ করে এরই মধ্যে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে চূড়ায় ওঠার প্রাথমিক টিমে তাকে রাখা হয়নি! গৌরবের সুখস্বপ্ন দেখার পরিবর্তে এখন তাকে এবং সেসময়ের সবচেয়ে অভিজ্ঞ হানযা ক্লাইম্বার মেহেদিকে চূড়ান্ত দলের মানে কম্পেগননি আর লাচেডেলির কাছে মহামূল্যবান অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো পৌঁছে দেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামতে হয়েছে। আগের রাতের মিটিং এ সাব্যস্ত হয়েছে, ২৫,৯০০ ফুট উচ্চতায় বরফের যে তুলনামূলক নিরাপদ অংশটুকু আছে সেখানেই কম্পেগননি আর লাচেডেলি ৯ নম্বর ক্যাম্প স্থাপন করবে। সারাদিন অমানুষিক খেঁটে সেই জায়গাটায় পৌঁছে তাঁরা দেখতে পেলো কোথায় ক্যাম্প! কোথায় কী! এখানে যে কেউই নেই!

আরও ওপরে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন তারা ওপরের দিকে রওনা দিলো তখনি ওদের জানা হয়ে গেছে যে আজকে ওদের আর নিচে নামা হচ্ছে না। সমস্যা নেই- তাতেও তো তাদের সঙ্গীরা পরেরদিন সামিটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো অন্তত হাতে পাচ্ছে আর কম্পেগননি আর লাচেডেলির সাথে এক তাঁবুতে কোনরকমে এই রাতটা কাটিয়ে দেয়া যাবে- ভাবল ওরা। কিন্তু ওদের কপালে যে কী লেখা আছে তা যদি ওরা তখন জানতো!

আরও কিছুদূর ওঠার পরও টিমের কারো কোন চিহ্ন না দেখে বোনেত্তি এবার চিৎকার করে তাদের ডাকলো। “আচিলি!! লিনো! তোমরা কোথায়? উত্তর দিচ্ছো না কেন?! আচিলি!! লিনো!” তার বারংবার ডা্কা নাম দু’টি পর্বতের গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসলো। এরই মধ্যে দোয়াতকালির মতো অন্ধকার নেমে এসেছে কে-টু এর বুকে। মেহেদির সাথে কোন হেডল্যাম্প নেই, বোনাত্তির সাথে যেটা ছিল সেটাও এখন আর কাজ করছে না। এবার সত্যিই চিন্তা হল বোনাত্তির। ওপরের ওদের কোন বিপদ হয়নি তো। তখুনি অন্ধকারের বুক চিরে দিয়ে একটা আলো জ্বলে উঠলো। নিশ্চয়ই ওপরের ওরা ওর ডাক শুনতে পেয়েছে- খুশিমনে ভাবল বোনাত্তি। অপ্রত্যাশিতভাবে আলোটা আসছে আগে থেকে ঠিক করে রাখা সামিট রুটের বেশ কয়েকশ ফুট ওপরের বামদিক থেকে। ওখানেই একটা বেরিয়ে থাকা পাথরের আড়ালে ক্যাম্প করেছে কম্পেগননি আর লাচেডেলি।

বোনাত্তি শুনতে পেলো লাচেডেলি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করছে, “অক্সিজেন এনেছো তোমরা?”

এপাশ থেকে বোনাত্তিও চিৎকার করে আশ্বস্ত করলো, “হ্যাঁ”

এবার অন্যদিক থেকে উত্তর এলো , “দারুণ। তাহলে এবার ওগুলো ওখানেই রেখে তোমরা সোজা নিচে চলে যাও!”

নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলো না বোনাত্তি। এর মানে কী ? লাচেডেলি কি বোঝাতে চাইলো !

বোনাত্তি আবার চিৎকার করে জানালো , “আমি পারবোনা! মেহেদির নামার মতো অবস্থা নেই!”

কিন্তু যেভাবে হঠাৎ করে লাইটটা জ্বলেছিলো ঠিক সেভাবেই হঠাৎ করে নিভে গেলো। মরিয়া হয়ে এবার মেহেদিও তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে চিৎকার করে উঠলো, “No good, Compagnoni Sahib! No good, Lacedelli Sahib!” বোনাত্তিও যোগ দিলো, “লিনো! আচিলি!! এসবের মানে কী ? আমাদের সাহায্য কর। দোহাই লাগে!” ৯ নম্বর ক্যাম্প থেকে একটা শব্দও কেউ উচ্চারণ করলো না! চিৎকার করে বারবার সাহায্যের আকুল আবেদন যেন ক্রমশ পর্বতের গায়ে প্রতিধ্বনি তুলে ওদেরকেই বিদ্রুপ করতে থাকলো……………

disputed-bivouck-k2
বোনাত্তি ও লাচেদেলি দুই দলের ক্যাম্প সাইট

রাগে, দুঃখে, হতাশায় বোনাত্তি বোবা হয়ে গেছে! একচুল নড়ার শক্তিও বোধ হয় হারিয়ে ফেলেছে ও। মেহেদির ডাকে সৎবিত ফিরল বোনাত্তির। তিক্ত সত্যিটা গিলতে সময় লাগছে বেশ! এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ওর, যে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক পর্বতটার বুকে ২৬,৫৭৫ ফুট উচ্চতায় একটা ঢালে ওরা আটকা পড়ে গেছে। ও ঠিকই নেমে যেতে পারতো নিচে, এমনকি হেডল্যাম্প ছাড়াই কিন্তু মেহেদির জন্য সেটা ছিল অসম্ভব। অদম্য সাহসী মেহেদি তখন ক্লান্তিতে, আতঙ্কে পাগলের মতো আচরণ শুরু করেছে। বেশ কয়েকবার বোনাত্তি ওকে একরকম জোর করেই নেমে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছে। সাথে তাবু নেই, তার মানে কোন আশ্রয়ও নেই, নেই কোন খাবার! তারপরও বেঁচে থাকার স্বাভাবিক তাগিদে ডানে-বাঁয়ে কোন বরফ বা পাথরের আড়াল খুঁজতে শুরু করলো ওরা। কিন্তু বিধিবাম। তেমন কিছুই তো চোখে পড়ছে না। শেষে এই উচ্চতায় যেটা আগে কেউ কখনো করার সাহস করেনি সেটাই করতে বাধ্য হল ওরা। একটা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত বিভোয়াক (বিশ্রামের উদ্দেশে বরফের গায়ে গর্ত খুঁড়ে বা পাথরের খাঁজে তৈরি করে নেয়া আশ্রয়স্থল)! এমন উচ্চতায় শুধু তীব্র বাতাস বা ঝড়ই নয়, সামান্য একটা বরফধস থেকে সাময়িকভাবে বাঁচার জন্য ন্যূনতম আড়ালটুকুও ওদের আর রইল না।

আইসএক্স বা বরফকুঠার দিয়ে বরফের গায়ে একটা চলনসই গর্ত খুড়তেই অনেকক্ষণ লেগে গেলো ওদের। খোড়া শেষ করে প্রথমে মেহেদিকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসলো বোনাত্তি। ঢালু বরফের গায়ে এইমাত্র তৈরি করা সমতল সিটের মতো জায়গাটায় এখন ওরা গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে আছে। কোথায় উষ্ণতা, কোথায় আশ্রয় ! তীব্র শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে নিজেদের ভাগ্যকে পরিহাস করাই সার হল ওদের…

চলবে…

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading