সেন্ট মার্টিনের প্রবাল বসতিতে গোলাবর্ষণ মহড়া; আদৌ কি যৌক্তিক?

শামসুজ্জামান খান

বাসার সামনে যখন উচ্চস্বরে মাইকিং হয় অথবা কোন অতি রসিক লাউড স্পিকারে হিন্দি গান বাজাতে থাকে তখন আপনার মনের অবস্থাটা কী হয়? মনে মনে গালাগাল তো ঠিকই করেন, ক্ষমতা থাকলে গিয়ে গম্ভীর গলায় বলেও আসেন, “ভাইয়া সাউন্ড টা কমাও।”

কেন? কারণ প্রত্যেকেরই শব্দ শোনার একটা নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। সেটা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, পরিবেশের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। শান্ত সমাহিত নৈস্বর্গিক কোন প্রাকৃতিক স্থানে বিকট শব্দ কি মানায়? আপনি না হয় ক্ষমতা থাকলে গিয়ে শব্দ বন্ধ করতে পারেন, ও বেচারা প্রকৃতি তো গৃহবন্দী নতুন বউ এর মত কেঁদেই মরে!

এমনিতেই স্পর্শকাতর প্রাকৃতিক স্থানে শব্দ করতে নিষেধ করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা, কারণ এতে করে সংশ্লিষ্ট স্থানের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর এটি যদি তীব্র আওয়াজের গোলাবর্ষনের শব্দ হয়, তাহলে?

প্রতিবেশগতভাবে সঙ্কটাপন্ন ঘোষিত এলাকা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবাল বসতিতে গোলাগুলির মহড়া করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘বিশেষ সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’তে দেখা যায়, নৌবাহিনী গত ১৮ জানুয়ারি, রবিবার থেকে এখানে গোলাবর্ষণের মহড়া শুরু করেছে।

smimse-835x480

সাম্প্রতিক নানা তথ্যচিত্রে দেখা গেছে, বিভিন্ন জাহাজ, ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের বেপরোয়া চলাচল এবং দায়িত্ব-জ্ঞানহীন পর্যটকের কারণে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল বসতিটির পূর্ব প্রান্তে এখন তেমন কোনো প্রাণবৈচিত্র্য অবশিষ্ট নেই।

তবে দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের সাগর এলাকায় এখনো প্রবাল বসতি রয়েছে। এখানেই  গোলাবর্ষণ মহড়া চালাচ্ছে নৌবাহিনী।

বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, পূর্বদিকে দ্বীপের সৈকতে ২০°৩৭.৪০ উত্তর অক্ষ ও ৯২°১৯.২০ পূর্ব দ্রাঘিমা, পশ্চিমে ২০°৩৭.০৫ উত্তর অক্ষ ও ৯২°১৭.০৯ পূর্ব দ্রাঘিমা, দক্ষিণ পশ্চিমে ২০°৩৬.১৭ উত্তর অক্ষ ও ৯২°১৭.৫০ পূর্ব দ্রাঘিমা, দক্ষিণে ২০°৩৫.৫৭ উত্তর অক্ষ ও ৯২°১৮.২৯ পূর্ব দ্রাঘিমা এলাকার মধ্যে এই মহড়া চালানো হয়।

এটি সহজেই অনুমেয়, এই গোলাবর্ষণের ফলে টিকে থাকা প্রবাল বসতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্বীপের চারপাশে যে ছড়িয়ে থাকা প্রবাল বসতি যেগুলো জলের ২৫ মিটারের মধ্যে সেগুলো গোলার আঘাতে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বা ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে যে আন্ডারওয়াটার ডাইভিং প্রয়োজন হবে সেটিও বিপদজনক হতে পারে, কেননা; পানির নিচে অবিস্ফোরিত গোলা থেকে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, দ্বীপটি সরকার ঘোষিত একটি প্রতিবেশগতভাবে সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে আইনত পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরদারিতে রয়েছে। এমন অবস্থায় এখানে মহড়া চালিয়ে একে আরও বেশী পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন করার কোন মানে আছে কি? এটা ঠিক যে, এই মহড়া কোথায় হবে এর উত্তর এই লেখায় নেই, কিন্তু আমাদের সম্পদ সেন্ট মারটিন বাচানোও আমাদের দায়িত্ব। নৌ বাহিনী আমাদের গর্ব। আমাদের সমুদ্র সম্পদ রক্ষার জন্যই নৌ বাহিনী। কিন্তু মহড়া করতে গিয়ে আমরা যদি আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ হারাই তাহলে একে কোথায় ফিরে পাবো?

পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনের অধিকারী হয়েও যেখানে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে আমরা বারবার ব্যর্থ হই, সেখানে প্রবাল দ্বীপ কি দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের নজরে আসবে?

লেখকঃ পরিবেশ বিজ্ঞানের ছাত্র ও প্রকৃতিপ্রেমী।

Related Articles

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading