সরীসৃপবিদ রম্যুলাস হুইটেকার এর সঙ্গে দশ মিনিট…

রম্যুলাস আর্ল হুইটেকার, বিশিষ্ট সরীসৃপবিদ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজক। ১৯৫১ সাল থেকে ভারতে বসবাসকারি এই মহান সরীসৃপবিদ ১৯৭২ সালে মাদ্রাজ স্নেক পার্ক, ক্রোকডাইল পার্ক, আন্দামান নিকোবরে স্থাপন করেন একটি প্রকৃতি অবলোকন কেন্দ্র। এছাড়া কাজের স্বীকৃতি সরূপ পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ বন বিভাগ ও কারিনাম(CARINAM) পরিচালিত বাংলাদেশ ক্রোকডাইল প্রোজেক্টের কাজ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে ঘুরে গেলেন এই সরীসৃপবিদ। স্বল্প সময়ের জন্য তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন এনভায়রনমেন্টমুভ ডট কমের প্রধান সম্পাদক তাওহীদ হোসাইন। দশ মিনিটের সেই সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো আমাদের পাঠকদের জন্য।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ সুপ্রভাত ! বাংলাদেশ এসে কেমন লাগছে ?

রম্যুলাসঃ কিছুটা ব্যস্ততার মাঝে সময় যাচ্ছে , তবে ব্যস্ততাটা উপভোগ করছি ।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ আপনার ছেলেবেলা সম্পর্কে কিছু বলুন । কিভাবে এবং কেন সরীসৃপ দের প্রতি আপনার আগ্রহ সৃষ্টি হল ?

রম্যুলাসঃ ৪ বছর বয়সে তখন আমি আমার পরিবারের সাথে নিউ ইয়র্ক শহরে থাকতাম, সমসাময়িক অন্যান্য বাচ্চারা যখন বেসবল , বাস্কেটবল খেলতে পছন্দ করতো , আমি তখন বাগানে বনে একা একা হাঁটতাম। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসতাম। পরিবারসহ ১৯৫১ সালে আমরা ভারত চলে আসি। তখন আমার বয়স ৮ বছর। ভারত জীব বৈচিত্র্য পূর্ণ দেশ। এখানে এসে প্রচুর বৈচিত্র্যময় প্রজাতির সন্ধান পাই। সৌভাগ্যবশত আমার ছেলেবেলাতেই আমি দক্ষিণ-ভারতে ইরুলা উপাজাতিদের সংস্পর্শে আসি। বস্তুত সেখান থেকেই আমার জীবন বদলে যায়। বিজ্ঞানের সাথে তাদের পরিচয় না থাকলেও , তারা প্রকৃত অর্থেই সাপ সম্পর্কে জানতো।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ সরীসৃপবিদ , বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ অথবা চলচিত্র প্রযোজক  কোন পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ?

রম্যুলাসঃ আসলে সংরক্ষণ এর প্রয়োজন হয় বিপর্যয় এর কারণে।   মনে কর তুমি কোনকিছু ভালোবাসো , এবং তোমার সামনে তা মেরে ফেলা হচ্ছে , ধীরে ধীরে সে বিলুপ্তির পথে , তখন অবশ্যই তুমি তাদের জন্য কিছু করতে চাইবে ? আসলে এ কারণেই মানুষ আমাকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকারী উপাধি দিয়েছে। আমি অনেক ভাবেই বিভিন্ন জায়গায় পরিচিত।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ মাদ্রাজ স্নেক পার্ক সম্পর্কে কিছু বলুন।

রম্যুলাসঃ মাদ্রাজ স্নেক পার্ক এর ধারণাটা মূলত পাই মায়ামি সর্প-পর্যবেক্ষণাগার থেকে। সেখানে আমি আমার গুরু উইলিয়াম হারস্ট এর অধীনে কাজ করি। কাজের ক্ষেত্রে উনি অত্যন্ত নীতিবান ছিলেন , ব্যক্তিগতভাবে আমিও তা অনুসরণ করি। এছাড়া ভারতে আসার পর আমি লক্ষ্য করলাম ভারতে সাপেদের রাজত্ব এবং সেখানকার মানুষ সাপেদের ব্যাপারে বিরূপ এবং নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। আমি এই নেতিবাচক আচরণের পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। এছাড়া একটা স্নেক-পার্ক এর মানে হচ্ছে সুন্দর একটা পরিবেশের মাঝে অনেক গুলো সাপের অবস্থান। তাই তামিলনাড়ু সরকার আমাকে প্রায় বিনামূল্যে , শহরের মাঝে এক বছরের জন্য ২৫০ রুপীতে , একটা জমির ব্যবস্থা করে দেয়।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ এটা ছিল ১৯৭২ সালে ?

রম্যুলাসঃ ( হেসে ) , দেখা যাচ্ছে এনভায়রনমেন্টমুভ এই সম্পর্কে জানে !

এনভায়রনমেন্টমুভঃ আসলে আমরা সবাইকে এই মহৎ উদ্যোগ সম্পর্কে জানাতে চাই ।

romulus whitaker

এনভায়রনমেন্টমুভঃ কুমীর জিন-ব্যাঙ্ক সম্পর্কে কিছু বলুন।

রম্যুলাসঃ কুমীর জিন ব্যাঙ্ক এর কাজ মাদ্রাজ স্ন্যাক পার্ক এর সাথেসাথে শুরু হয়। প্রথমে আমাদের কাছে দুইটি কুমীর ছিল। এরা এক বছরের মাঝে  ডিম পাড়ে। সাপ এবং অন্যান্য সরীসৃপ এর সংখ্যার তুলনায় আমাদের কাছে জমির পরিমাণ ছিল খুবই অপ্রতুল। মাত্র আধা একর। তখন আমাদের মাথায় একটা আলাদা অবকাঠামো স্থাপনের চিন্তা আসে। চেন্নাই শহরে দক্ষিণে পূর্ব উপকুলে আমরা মাদ্রাজ কুমীর জিন-ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করি। প্রথমে আমরা ১৪টি কুমীর নিয়ে আসি। কয়েক বছরের মাঝেই কুমীরের সংখ্যা হয় ১০০। এবং এখন এখানে ১৮টি প্রজাতির প্রায় ২০০০ কুমীর আছে। এটি বিশ্বের প্রায় সব প্রান্ত থেকে সংগৃহীত একটি জিন-ব্যাঙ্ক।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ বাংলাদেশে আসার পেছনে কি এটাও একটা কারণ ? পার্কের সম্প্রসারন এর জন্য ?

রম্যুলাসঃ আসলে এর জন্য প্রথমেই ধন্যবাদ জানাতে হয় জেনেভার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা কে। সেখানে আমি প্রথম কুমীর এর প্রথাগত বানিজ্যিক সদ্বব্যবহার সম্পর্কে কথা বলি। অনেকে তখন আমাকে এসে বলেন যে আমার পরিচয় একজন সংরক্ষণবিদ হিসেবে , কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রাকৃতিক প্রাণবৈচিত্র্যের কার্যকর ব্যবহারে বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি , অনেক প্রজাতি এবং প্রাণবৈচিত্র্য -যত্নসাধ্য সদ্ব্যবহার এর মাধ্যমে রক্ষা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সতর্কতা এবং সাবধানতা অবলম্বন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আমাকে ১৯৮২ সালে সুন্দরবন নিরীক্ষণ এর জন্য আমন্ত্রন জানানো হয়।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ এখনো এখানে প্রচুর প্রজাতির অবস্থান বজায় আছে কি ?

রম্যুলাসঃ আমি ১৯৮২ সালে সুন্দরবনে মাত্র ৪টি কুমীর এর দেখা পাই , এবং এটা খুবই আশ্চর্যজনক । এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন এবং এখানে এত কম সংখ্যক কুমীরের দেখা পাওয়াটা সত্যিই অনেক উদ্বেগজনক। আমি তখন বুঝতে পারি এখানে বড় ধরনের কোন বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছে।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ আপনার কী মনে হয় ? এই বিপর্যয়ের কারণ কী ছিল ?

রম্যুলাসঃ বন বিভাগের এর তথ্যানুযায়ী , ১৯৫০ সালে চামড়া ব্যবসার কারণে হাজার হাজার কুমীর হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া সেই সময়টাতে মানুষ কুমীরের প্রতি নেচিবাচক ধারণা পোষণ করতো। এখন তারা সংরক্ষণ এর ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছে , কিন্তু বাস্তবতা হল কুমীরের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি হয় না। তাদের প্রজনন হার খুবই ধীর গতির। অনেকে ধারণা করে এর একটা কারণ হল মানুষের অত্যধিক উপস্থিতি এবং উপদ্রব । প্রকৃত কারণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি , তবে এটা আংশিক কারণ হতেও পারে। এজন্যই “কারিনাম” ( CARINAM – Centre for Advanced Research in Natural Resources & Management ) এবং রশীদ ( এস.এম.এ রশীদ ) এর কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বনবিভাগ বিভাগ তাকে এক্ষেত্রে সাহায্য প্রদান করছে এবং উভয় এখন পক্ষের সমন্বয় সাধন করে কাজ করা খুবই প্রয়োজন।

from left-- Romulus Whitaker, Tawhid Hossain, S.M.A Rashid after the interview
from left– Romulus Whitaker, Tawhid Hossain, S.M.A Rashid after the interview

এনভায়রনমেন্টমুভঃ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এর সম্ভাবনা এবং বাস্তবতা সম্পর্কে আপনার মতামত কি ?

রম্যুলাসঃ বাংলাদেশ অনেক সমস্যা জর্জরিত দেশ। এই দেশটিকে অনেক চাপ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। একই পরিস্থিতিতে ভারতের সাথে তুলনা করে দেখলে তাদের তুলনায় এখানে উন্নয়নের জন্য অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত। বন্যপ্রাণী এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সহাবস্থানের ব্যাপারে এখানকার মানুষের মনোভাব সহনশীল। সীমান্ত অঞ্চলবর্তী এলাকায় এবং পাহাড়ি এলাকায় হাতিদের উপদ্রব সত্ত্বেও এখানকার মানুষ হাতি নিধন এ আগ্রহী নয়। ভারত এবং বাংলাদেশের মানুষের মাঝে আমি সুন্দর একটা সাধারণ সার্বজনীনতা খেয়াল করেছি যে তারা আসলেই অনেক সহনশীল। তাই এই মানুষগুলোর জীবিকা এবং অস্ত্বিত্ব রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। কুমীর কিংবা হাতি দ্বারা তাদের কোন ক্ষতি আমাদের কাম্য নয়।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত তরুণদের , সংরক্ষণ উদ্যোগকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করাকে কিভাবে আরো অনুপ্রাণিত করা যায় বলে আপনার ধারণা ?

রম্যুলাসঃ আমার মনে হয় এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্ভাব্যভাবে সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটিই অনুসরণ করছে। ভারতের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। প্রতিবছর এনসিবিএস ( NCBS ) , বেঙ্গালোর এর ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সাইন্স এর মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সংরক্ষণ বিজ্ঞান এর ওপর শিক্ষার্থীদের আলোচনা সভা পরিচালনা করা হয়। আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতায় তারা প্রতি বছর সফলতার সাথে অবদান রাখছে। আমি যখন আমার কাজ শুরু করি , খুবই অল্প সংখ্যক তরুণ আমার সাথে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এর কারণ ছিল , তাদের অভিভাবকদের মতামত ছিল যে তাদের সন্তানদের জন্য এটা উপযুক্ত চাকরী নয়। “শখের বশে কৌতূহল এর কারণে হয়তো তুমি এটা করতে পারো , কিন্তু এটাকে তুমি পেশা হিসেবে নিতে পারো না।“ এখন পরিস্থিতি অনেক ভিন্ন। এই ক্ষেত্রে চাকরীর সুযোগ এবং সম্ভাবনা এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ শেষ প্রশ্ন। সরীসৃপ নিয়ে কাজ করার সময় আপনার সবচেয়ে ভালো মুহূর্তটি আমাদের সাথে শেয়ার করবেন কি ? অথবা সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত ?
রম্যুলাসঃ সবচেয়ে ভালো মুহূর্ত ………… প্রতিটিদিনই তো ঘটছে। আসলে আমি খুবই সৌভাগ্যবান আমাকে পাপুয়া নিউগিনিতে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। আন্দামান নিকোবর দ্বীপে আমি একটি বেস স্থাপন করি। এই ঘটনা গুলো অনেক ফলপ্রসূ এবং উত্তেজনাপূর্ণ। এই স্থানগুলোতে যাওয়া এবং সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে মেলামেশার স্মৃতিগুলো আমার কাছে সবচেয়ে স্মরনীয়। আমাদের যাকে “প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা” বলি , তাদের তা নেই। কিন্তু তারা আমাকে যা শিখিয়েছেন , কোন অধ্যাপক হয়তো তা পারতেন না। আমার বিজ্ঞানে কোন ডিগ্রী নেই , আমি কখনো কলেজ এ যাইনি। কিন্তু আমার উপলব্ধি , বোধশক্তি খুবই দৃঢ়নিষ্ঠ। আমি মনে করি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

( হাসতে হাসতে ) আশা করি এটা ভুল বার্তা হিসেবে প্রচারিত হবে না।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ আমি এখানে আসার আগে আমার এক বন্ধু আমাকে একটা প্রশ্ন করার জন্য অনুরোধ করেছে । অজগর সাপ কি আসলেই মানুষ গিলে ফেলে ?

রম্যুলাসঃ ( হাসতে হাসতে ) তুমি কি সেই সিনেমাগুলো দেখতে পছন্দ কর, যেখানে অজগর সাপ একটা আস্ত মানুষ খেয়ে ফেলে? আসলে হলিউড এর চলচ্চিত্র গুলো এই ধারণাগুলো মানুষের মনে ছড়িয়ে দিচ্ছে , প্রকৃত তথ্যের ভুল উপস্থাপন হচ্ছে। ভারতেও কিং কোবরা সাপের উপর চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ভয়ঙ্কর সব ঘটনা নিয়ে এগুলো নির্মাণ করা হয় , কিং কোবরা সাপ মানুষের উপর তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে – এবং সাধারণ মানুষ এসব বিশ্বাসও করে!! এর চেয়ে বন্যপ্রাণী , পরিবেশের বৈচিত্র্যতা দেখাও অনেক ভালো।

এনভায়রনমেন্টমুভঃ এর জন্যই আমি ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেল এ আপনার অনুষ্ঠান দেখি ।

( হাসি বিনিময় )

এনভায়রনমেন্টমুভঃ আপনার মূল্যবান সময় এর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

রম্যুলাসঃ তোমাকেও ধন্যবাদ। আশা করছি ভবিষ্যতে আবার দেখা হবে।

অনুবাদঃ নির্মাণ ভৌমিক।

এই সাক্ষাৎকারটির মূল ইংরেজিতে পড়তে ও দেখতে ক্লিক করুন এখানে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading