দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য নিরাপত্তার অধিকার আদায়ে নতুন দিগন্তের সূচনা

মনিজা মনজুর

খাদ্য প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার সমবন্টন এবং নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গত ৩০ মে হতে ১ জুন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘দক্ষিণ এশিয়া খাদ্য অধিকার সম্মেলন-২০১৫’। ৩০ মে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মেলনের শুভ সূচনা করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিন জলবায়ু পরিবর্তন, সার্ক বীজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, পুষ্টি নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য, ভূমি নিরাপত্তা, খাদ্যশষ্যের বিকল্প উপায় সহ নানা বিষয় নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা আলোচনা এবং মতবিনিময় করেন। মোট ১২টি কারিগরি, ৪টি প্লেনারি, ২টি বিশেষ অধিবেশনে এসব সমস্যা সমাধানে নানা পদক্ষেপ গৃহীত হয়। সম্মেলনের ভিন্ন ভিন্ন অধিবেশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিল্পমন্ত্রী জনাব আমির হোসেন আমু; কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী; অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত; বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন; বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ডঃ আতিউর রহমান; দিল্লী পলিসি গ্রুপের অধ্যাপক ডঃ অমিতাভ কুন্ডু; ড. পূর্ণিমা ডরিস চট্টোপাধ্যায়,জিআইজেড; প্রফেসর এমিরেটাস ড. আইনুন নিশাত সহ আরো অনেকে।

প্রথম কারিগরি অধিবেশনের বিষয় ছিল, ‘দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে খাদ্য নিরাপত্তা’। এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শর্মিন্দ নীলর্মি। তিনি বলেন, WFP এর মতে দক্ষিণ এশিয়ায় শুধুমাত্র দারিদ্র্যের কারণে ৭৯৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চাষযোগ্য মাটিক্ষয়, লবণাক্ততা, ভূগর্ভস্থ পানির অপসারণ এবং যথেচ্ছ ব্যবহার, কার্বন ডাই অক্সাইড এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়। তিনি প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক বন্টনের পাশাপাশি জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের পরামর্শ দেন।

খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি জোরালোভাবে পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টিও উঠে আসে। শুধুমাত্র খাদ্যশষ্য উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, সাথে গবাদি পশু এবং মাছ চাষের দিকেও সমান অধিকার প্রয়োগ করা উচিৎ বলে মনে করেন বক্তারা। এছাড়া খাদ্য প্রস্তুত প্রণালীর দিকেও আলোকপাত করে তাঁরা বলেন প্রথাগত উপায়ে খাদ্য রান্না এর পুষ্টি গুণাগুণ অনেকটাই নষ্ট করে দেয়। তাই রান্নার সময় এর পুষ্টিগুণ বিচারের দিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত।

03

অক্সফাম এর পলিসি অ্যাডভাইসর ডের্ক উইলেম বেইভ্যাঙ্ক ক্ষুধাকে একটি রাজনৈতিক ঘটনা বলে উল্লেখ করে বলেন, খাদ্য উৎপাদনের সাথে এর সঠিক বন্টনও জরুরি। তাই এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে বৈশ্বিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে এর সুষম বন্টন নিশ্চিত করা যায়।

‘কৃষিখাতে বিনিয়োগ’ শীর্ষক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ডঃ আতিউর রহমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। উন্নত যন্ত্রের ব্যবহারে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত এবং পাকিস্তানের তুলনায় ১৯৯২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্যতার হার ১.৭% এ নেমে আসে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি শষ্য নিরাপত্তা অপেক্ষা গবেষণা খাতে বিনিয়োগের উপর গুরুত্বারোপ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক হতে গবেষকদের সহায়তা এবং অবসরপ্রাপ্ত গবেষকদের জন্য একটি ফাউন্ডেশন, গ্রীন ব্যাংকিং, জৈবসারে ভর্তুকি, ৫% ভর্তুকিতে গবাদিপশু ক্রয় এবং মশলা চাষে ৪% ভর্তুকি এর কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতিতে বাংলাদেশের সাফল্যের বিষয়গুলো এখনো অনেকের অজানা’।  ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোও সকল সুবিধার আওতায় আনা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী কৃষক এবং জমির মালিকদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন, আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারে ২৫% ভর্তুকি, বর্গা চাষিদের ঋণ প্রদান, কৃষি জমির অপব্যবহার রোধের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়া তিনি জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে সহনীয় তাপমাত্রায় ভূট্টার চাষ বৃদ্ধি করার জন্য গবেষণা চলছে। উন্নত রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যারা খাদ্য অপচয় করে জৈবজ্বালানী তৈরী করছে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।

05

আরেকটি গুরুতকপূর্ণ বিষয় উঠে আসে এই সম্মেলনে। আর তা হলো- খাদ্য নিয়ে রাজনীতি। মার্কিন কোম্পানি মনসান্টো ও ভারতীয় কোম্পানি মাহিকো মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে বিটি বেগুন  এবং অন্যান্য ক্ষতিকর খাদ্যের প্রবর্তন করে খাদ্য শৃংখলকে নষ্ট করছে এবং জৈব পরিবেশের ক্ষতি করছে। উল্লেখ্য যে, কর্পোরেট সমাজ কৃষকদের কথা কখনোই চিন্তা করেন না, বরং মুনাফা লাভে বিটি বেগুন চাষে কৃষকদের প্রলুব্ধ করা হয়। কোম্পানির একচ্ছত্র আধিপত্যে কৃষকেরা যেমন ন্যায্য দাম পায় না, অন্যদিকে অজ্ঞতার কারণে বিটি বেগুনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কেও অনেকেই জানেন না। ড. শহিদুর রহমান এবং কবিতা শ্রীবাস্তব তাদের বক্তব্যে জোরালোভাবে আইন প্রনয়ন এবং কার্যকর করে শুধুমাত্র বিটি বেগুন নয়, এরূপ যে কোনো ধরনের খাদ্য উৎপাদনের এই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার রোধের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামের যৌথ কৃষি ব্যবস্থার বিকল্প অর্থাৎ ‘কর্পোরেট কৃষির বিকল্প’ -শীর্ষক আলোচনায় পাকিস্তানের প্রতিনিধি নাসির আজিজ, ভারতের ব্যোমকেশ লাল সকলেই এক্ষেত্রে নিজ নিজ দেশের সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।

01

অন্যদিকে কার্বন ট্রেডিং এর ফলে উন্নত ধনী রাষ্ট্রের জলবায়ু পরিবর্তনের বোঝা নেমে আসছে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার উপর। যার ফলে দক্ষিণ এশিয়া কে মোকাবেলা করতে হয় নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগের। এক্ষেত্রে  দক্ষিণ এশিয়ার সকল রাষ্ট্রের একত্র হয়ে কাজ করার সম্মতি প্রদান করেন।

ইউএসএইড এবং অক্সফাম খাদ্য নিরাপত্তায় তাদের গৃহিত পদক্ষেপের ব্যাপারে উল্লেখ করেন তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি এবং অক্সফাম  খাদ্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সকলকে একত্রিত হওয়ার আহ্বানে তাঁদের আয়োজনে একটি পিটিশনের কথা উল্লেখ করেন।

02

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সমন্বয়ের জন্য কৃষি, খাদ্য, প্রাণী এবং পরিবেশ এই  চারটি মন্ত্রণালয়কে একত্রে কাজ করার ব্যাপারে মত দেন বিশিষ্টজনেরা। এছাড়াও আরো যে সকল সুপারিশ উঠে আসে তা হলো-

১। জলবায়ু সংক্রান্ত ন্যায়বিচার আইন  প্রণয়ন

২। নারী কৃষকদের স্বীকৃতি প্রদান

৩। কৃষি জমি সুরক্ষা আইন প্রনয়ন

৪। জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার

৫। আঞ্চলিক সহযোগিতা

৬। সার্ক বীজ ব্যাংক কার্যকর করা

৭। সরকা্রি-বেসরকারি পর্যায়ে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা

৮। তৃণমূল পর্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকা

৯। ভূমি আইন কার্যকর করা

১০। প্রয়োজনে আই সি টি ব্যবহার নিশ্চিত করা

১১। সরকারি কাজে স্বচ্ছতা আনয়ন এবং জবাবদিহিতা  সহ আরো অনেক সুপারিশ উঠে আসে বিভিন্ন আলোচনায়।

সকল সুপারিশকে আমলে রেখে একটি চার্টার ঘোষণা করা হয় এবং ৬১ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় পর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এই কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ডঃ কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ, চেয়ারম্যান, পিকে এস এফ; ভাইস চেয়ারম্যান শাহীন আনাম, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং  সমণ্বয়ক নির্বাচিত হন মোহসিন আলি, কার্যনির্বাহী, সার্ফস এবং এন্টি পোভার্টি প্রোগ্রাম। প্রাথমিকভাবে যে ৪৩ টি সংগঠন এই আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তারা জাতীয় কমিটিতে থাকবেন, সেই সাথে ভবিষ্যতে আরো সংগঠন যুক্ত হবেন। প্রত্যেকটি বিভাগ অনুযায়ী এক একজন সদস্য কাজ করবেন। সম্মেলনের সমাপনী বক্তব্যে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সকল সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেওয়ার কথা বলেন।

সবশেষে জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাস, আইনের যথাযথ প্রনয়ণ, কৃষি-শ্রমিক অধিকার আইন, সার্ক বীজ ব্যাংক কার্যকর এবং সহ রাষ্ট্রগুলোকে একসাথে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ক্ষুধামুক্ত দক্ষিণ এশিয়া গড়ার একটি নতুন দুয়ার উন্মোচনের সূচনা করা হয়।

এনভায়রনমেন্টমুভ এর সৌজন্যে ছবিগুলো তুলেছেন গোলাম রব্বানী রায়হান।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading