প্রজাপতির টানে, লাওয়াছড়ার পানে

শাওন চৌধুরী

২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫… প্রজাপতি দেখা শুরু করেছি খুব বেশিদিন হয়নি কিন্তু এই অল্পদিনের মধ্যেই এই রঙিন পাখার পতঙ্গের প্রতি ভাললাগার মাত্রা প্রতিদিন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে! সারাদিনের ল্যাবের ঝক্কি-ঝামেলা শেষ করতে দুপুর হয়ে গেছে, তখন এক বন্ধুর ফোন আসে যে, লাওয়াছড়া যাবে প্রজাপতি দেখতে। যেহেতু অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল প্রজাপতির স্বর্গ হিসেবে খ্যাত এই বনকে অন্তত একবার সামনে থেকে দেখা, যার কারণে ঐ প্রস্তাব ফেলতে পারিনি! বাসায় এসে ৩০ মিনিটের মধ্যেই গোসল, খাওয়া শেষ করে কোনমতে ব্যাগ গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়ি শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে।

দেশের অবস্থা স্বাভাবিক না থাকার কারণে প্রতিদিনই হরতাল ছিল, ঐ মঙ্গলবারও বাদ পড়েনি কিন্তু যদি মনের ইচ্ছা থাকে তাহলে কে আটকে রাখতে পারে! আমরা তিনজন সায়েদাবাদে যেয়ে বাসের খোঁজ করতে থাকি কিন্তু জানতে পারি যে হরতালের কারণে বিকেলের পরে ঐ রুটে বাস চলেনা! তখন অগত্যা মধুসূদনের মতন কমলাপুর ছুটি ট্রেনের টিকেটের আশাতে। স্বাভাবিকভাবেই সৎ উপায়ে টিকেট পাওয়ার কোন উপায় ছিলনা তার পরেও টিকেট কাউন্টারের লোকের কাছে এমন কিছু টিকেট থাকে যা সে ২৫/৩০ টাকা বেশিতে বিক্রি করে!

unnamed (1)
Painted Jezebel (Delias hyparete)

যেহেতু রাত হয়ে গেছে আর ভাল বাসও চলছেনা যার কারণে ঐ টিকেটে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা। ট্রেন ছিল রাত ৯.৫০ এ। তখনো হাতে কয়েকঘন্টা বাকি। সারারাতের ট্রেনের ধকলের কথা চিন্তা করে আমরা আরামবাগ যেয়ে রাতের খাবার খেয়ে আসি যাতে করে রাতে আর ট্রেনের এক সপ্তাহ আগের নষ্ট খাবার না খেতে হয়! অতঃপর ট্রেনে সময়মতো উঠে পড়ি যদিও ট্রেন ৩/৪মিনিট পরে ছেড়েছিল।

unnamed (2)
Indian Awl King (Choaspes benjaminii)

যাই হোক, লাওয়াছড়ার প্রজাপতির কথা চিন্তা করে সারারাত ঘুমতো হলই না বরঞ্চ বসে বসে ভোর পর্যন্ত বাইরের শীতল বাতাস উপভোগ করতে থাকলাম। ভোর ৪.৪০ এর দিকে ট্রেন থেকে নেমে দেখি চারপাশে ঘোর অন্ধকার আর গরমের রাত্রেও মনে হচ্ছে শীতের রাত। বয়ে যাওয়া হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস আর অনেক নতুন প্রজাপতি দেখবো এই চিন্তা সারারাত না ঘুমিয়ে থাকার ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর করে দিয়েছে। স্টেশন থেকে চা খেয়ে আমরা হোটেলে যেয়ে কোনমতে হাত-মুখ দিয়ে নীচে হোটেলে নাস্তা করতে নামি। এতো তাড়াতাড়ি নামার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে আমার ক্যামেরাতে চার্জ ছিল না আর আমাদের রুমে আমার ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ দেয়ার জন্য কোন পোর্ট ছিলনা।

unnamed (4)
Chestnut Angle (Odontoptilum angulata)

যাই হোক, নিচে নেমে ধীরে সুস্থে হালকা কিছু খেলাম এবং ব্যাটারিতে চার্জ দেয়া শেষ হলে উঠে সিএনজিতে করে লাওয়াছড়াতে পৌঁছলাম। জীববৈচিত্র্যের সাথে জোক আর মাইটসের জন্য এই বন বিখ্যাত হবার কারণে ফুল হাতা জামা লম্বা মোজা আর মোজার ভেতরে প্যান্ট ঢুকিয়ে বনে ঢুকে পড়লাম। ঢোকার পূর্বমুহূর্তেই একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো যে, সাধারণ মানুষদের টিকেটের মূল্য ২০টাকা আর ছাত্রছাত্রীদের জন্য সেটা ১০ টাকা। ছাত্র হবার কারণে এই সুযোগটা লুফে নিলাম। যদিও ঐ সময়ে টিকেট দেয়ার মতন কেও ছিল না তারপরও বের হবার পরে আমরা টিকেট কেটেছিলাম।

unnamed (3)
Common Red Forester (Lethe mekara)

ক্যামেরা বের করে হাটা শুরু করার সাথে সাথেই আমরা অনেক প্রজাপতি পেলাম। যেহেতু আমি নিজে প্রজাপতি দেখার উদ্দেশ্যে ঢাকার বাইরে যাইনি যার কারনে এখানকার বেশিরভাগ প্রজাপতিই আমার জন্য নতুন হবার কথা। তাই প্রজাপতি দেখলেই মনে হচ্ছিলো হয়তো এটা আমার জন্য নতুন কিছু! কিন্তু কাছে যাবার পরে ভুল ভাঙ্গে কারণ প্রায় সবই ছিল Evening Brown নামক প্রজাপতি। রেললাইনের আগে One Spot Grass Yellow, Common Fivering, Grey Count ও আরও কিছু নতুন প্রজাপতি দেখলাম। দেখার সাথে সাথেই মনে হলো হয়তো ঢাকার মতন এখানেও প্রজাপতির বৈচিত্র্য থাকলেও বিস্তৃতি খুব একটা নেই কিন্তু একটু সামনে যেয়েই ভুল ভাঙলো। যা দেখি তাইই ফাইভ রিং।

unnamed (5)
Chocolate Albatross (Appias lyncida)

রেল লাইন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনে যেতেই আরও কিছু প্রজাপতি দেখলাম। বুনো পরিবেশে থাকতে থাকতে এগুলো সাধারণত মানুষের সাথে খুব একটা পরিচিত নয় যার কারণে অনেক কাছাকাছি প্রজাপতিগুলো দেখতে পেলাম, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ওদের নিশ্বাসও অনুভব করতে পারছি! রেল লাইনে কিছু সময় হাঁটার পরে আমরা প্রধান সড়কে নেমে পড়লাম এবং কিছু সময় হাঁটার পরে এক ঝাঁক প্রজাপতির দেখা পেলাম, প্রায় ১৪-১৫ টা প্রজাপতি একসাথে উড়ছিল। এর মধ্যে ছিল Long Banded Crow, Striped Blue Crow, Common Crow এবং আরও কিছু!

unnamed (6)
Puddling Beauties

ডিজিটাল ক্যামেরার কারণে এই ঝাঁকের ছবিটা নিতে না পারার দুঃখটা কিছুটা হলেও রয়ে গেছে। যাই হোক একটু সামনে যেয়ে ছড়া পেলাম। এসব ছড়াগুলোকে প্রজাপতির বাসা বললেও ভুল হবেনা। এসব ছড়ার মধ্যেই এদের খাবার সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিপরীত লিঙ্গের সদস্যের সাথে মিলন পর্যন্ত সবই চলতে থাকে। জুতা পড়েই পানির মধ্যে দিয়ে আমরা তিনজন হাঁটছি আর মাঝে মাঝেই অপূর্ব সুন্দর কিছু প্রজাপতির দেখা পাচ্ছি যা দেখে শরীরের ক্লান্তি কিংবা মাঝে মাঝেই প্রায় হাঁটু পর্যন্ত পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়াকে কিছুই মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ছড়ার শীতল পানিতে শুয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দেই!

unnamed (7)
Puddling Beauties

এভাবে হাঁটতে হাঁটতে Common Birwing, Red Helen, Painted Jezebel, Red-base Jezebel, Common Nawab, Pallid Nawab, Tawny Rajah সহ আরও অনেক বেশি সুন্দর কিছু প্রজাপতির দেখা পেলাম। প্রজাপতিগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, একটা পতংগ কিভাবে এতো রঙিন হতে পারে! বিস্ময়কর চোখে এদের ওড়া, নরম মাটি বা বানরের এক্সক্রিটা থেকে খাবার সংগ্রহ দেখছিলাম, একবারের জন্যও ওখান থেকে উঠে যেতে ইচ্ছা করছিল না তবুও সময় স্বল্পতার কারণে মন খারাপ করে উঠে যেতে হয়েছিল কিন্তু কয়েক কদম হাঁটার পরে আরেক নতুন প্রজাপতি দেখে মন আবার অনেক বেশি ভাল হয়ে যাচ্ছিল।

unnamed (8)
Tawny Rajah (Charaxes aristogiton)

এভাবে কয়েক ঘন্টা ছড়ার পানিতে হাঁটার পরে অনেকগুলো নতুন প্রজাপতির দেখা পেলাম। খুশি মন নিয়ে হাঁটছি সামনের দিকে… হঠাৎ করে চোখ পড়লো আমার স্বপ্নের প্রজাপতির দিকে যে কিনা ছড়ার সাথের একটা গাছের পাতায় বসে রোদ উপভোগ করছিল। একে দেখার পরে ছবি তোলার কথা ভুলে যেয়ে কিছুসময় তাকিয়েই থাকলাম এবং সম্বিৎ ফিরে পাবার পরে ছবি তোলার কথা মনে হলো এবং অনেক কাছ থেকে কিছু ছবি নিতে পারলাম। একথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে প্রজাপতি নিয়ে যারা কাজ করে তাদের বেশিরভাগের কাছেই Orange Oakleaf একটা স্বপ্নের প্রজাপতি আর এদের সৌন্দর্য দেখে যে কারোর মাথা নষ্ট হতে বাধ্য।

The orange oakleaf (Kallima inachus)
The orange oakleaf (Kallima inachus)

স্বপ্নের প্রজাপতির দেখা মেলার পরে কতোটা ভাল লাগছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। এভাবে আরো কিছু সময় ছড়ায় কাটানোর পরে প্রায় ১.৪৫ এর দিকে আবার হোটেলের উদ্দেশ্যে বের হলাম। প্রথমদিন প্রায় ৫৬-৫৭ প্রজাতির নতুন প্রজাপতি দেখলেও ছবি তুলতে পেরেছিলাম ৫১ প্রজাতির। প্রথমদিন জুয়েল নওয়াব এর দেখা না পেলেও পরদিন ঠিকই ছবি তুলেছিলাম।

unnamed (9)
Jewelled nawab (Polyura delphis)

পরদিন লাওয়াছড়া থেকে ৪টার পরে বের হয়ে ৫.৪৫ এর বাসের টিকেট কেটে হোটেলে ফিরে কোনমতে সবকাজ শেষ করে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। অন্ধকার রাতের শোভা বাঁড়াতে রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য জোনাকি পোকা জ্বলছে আর নিভছে, মনে হচ্ছে যেন ওরা আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এগুলো দেখতে দেখতে কখন যে, প্রাণহীন শহর ঢাকাতে পৌঁছে গেলাম টেরও পেলাম না।

Related Articles

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading