মৃত্তিকা ও জলবায়ু; কিছু সমাধান, কিছু নির্ভরতা!

মনিজা মনজুর

মৃত্তিকা বর্ষের নভেম্বর মাসের প্রতিপাদ্য বিষয়- মৃত্তিকা ও জলবায়ু। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এখন সমগ্র পৃথিবী সোচ্চার। মৃত্তিকার সাথে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার এক অনন্য সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। শিল্পকারখানা ছাড়াও অসংখ্য উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী এই কার্বন ডাই অক্সাইড। এই বিপুল পরিমাণ গ্যাস যাতে বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে না পড়ে, একে বন্দী করার ব্যবস্থা করেছেন বিজ্ঞানীরা। অনেকটা প্রদীপের দৈত্য বন্দী করার মত ব্যাপার। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘কার্বন ক্যাপচার’ বা ‘কার্বন সিকুয়েস্ট্রেশন’। পরিবেশে যে বিপুল পরিমাণ কার্বন ছড়িয়ে পড়ে তাকে এক বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে মাটির হাজার ফুট নিচে বছরের পর বছর সঞ্চিত করে রাখা হয়। একে সবুজ কার্বনও বলেন অনেকে। শুধুমাত্র মাটিই নয়, পানির নিচেও অর্থাৎ সমুদ্রের তলদেশেও কার্বন সঞ্চয় করে রাখা যায়, যাকে নীল কার্বন নামে অভিহিত করা যায়।
nitrogen-cycle-2
মাটির নিচে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন টন মানব সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড সঞ্চয় করে রাখা যাবে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। সাধারনত, কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস পৃথিবীর গভীরের, উচ্চচাপে তরলের ন্যায় আচরণ করে। সচ্ছিদ্র পাথরের ভিতরে ঢুকে অল্প জায়গায় প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড সংরক্ষণ করা যায়। এই পদ্ধতিকে ‘জিওলজিক্যাল সিকুয়েস্ট্রেশন’ বলা হয়। মাটির নিচের পাথর স্তরে পাইপলাইনের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড প্রবেশ করানো হয়। এই প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগারগুলোর উপরে পাথরের আরেকটি স্তর থাকে যা ভেদ করে এই গ্যাস বের হতে পারে না। এটি একটি ঢাকনার মত কাজ করে গ্যাসকে আটকে রাখে। গবেষকরা দেখেছেন যে ব্যাসাল্টে (আগ্নেয় শিলা) কার্বন ডাই অক্সাইড প্রবেশ করালে তা পরবর্তীতে চুনাপাথরে রুপান্তরিত হয়। ফসল উৎপাদন এবং জলাভূমি সংরক্ষনও মাটিতে কার্বন জমা করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে দুর্বল মাটি, বনায়ন ধ্বংস প্রভৃতি কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে থাকে। তাহলে বুঝতে পারছেন? জলবায়ুর উষ্ণতা কমানোর সমাধান লুকিয়ে আছে মৃত্তিকায়!

মৃত্তিকা হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা ভূগর্ভস্থ শিলার বিভিন্ন উপায়ে পরিবর্তিত হওয়ার এক বিশেষ রূপ। কোনো একটি অঞ্চলের জলবায়ু কিরূপ ছিল তা সেই অঞ্চলের মাটি দেখে সনাক্ত করা যায়। এই বিশেষ মাটিকে বলা হয় “প্যালিওসল”। এর আরো একটি বিশেষত্ব হল, হাজার বছর পূর্বে ওই অঞ্চলের জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা দিয়ে, তা কিভাবে বর্তমানের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো যায়; এটি সেই ধারণাও দেয়।

শুষ্ক অঞ্চলের উৎপাদনশীল জমিতে মরুকরণ বর্তমানে আরো একটি অন্যতম সমস্যা। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ জায়গায় প্রায় ১০০টির ও বেশি দেশ মরুকরণের ঝুঁকিতে আছে, এমনকি আমেরিকাও। টেক্সাস, ওয়িকোহোমা, কলোরাডো এর মত অঙ্গরাজ্যগুলো অতিরিক্ত ভূমিকর্ষণ এবং চারণের কারণে ১৯২০ সাল থেকেই মরুকরণের শিকার। নদীতীরবর্তী বনায়ন, স্বল্প ভূমিকর্ষণ, পরিকল্পিত পানি প্রবাহ দ্বারা মরুকরণ কমিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া খরাপ্রবন অঞ্চলেও মৃত্তিকার পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য ফসল উৎপাদন এবং কৃষিকাজ ত্বরান্বিত করা সম্ভব।

মৃত্তিকা জীবন ধারণ করে। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে মৃত্তিকার অভ্যন্তরে কার্বন জমা রাখার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তবে মৃত্তিকা কতটুকু পরিমাণ একে ধারণ করতে পারবে, সেদিকে লক্ষ্য করা উচিত। সেই সাথে, ফসল উৎপাদনে যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেই দিকটি নিয়েও ভাবনার প্রয়োজন আছে বৈকি!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading