বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী!

দিব্য কান্তি দত্ত

আপনাকে যদি বর্তমান বিশ্বের প্রধান সমস্যাগুলোর একটা ছোটখাট তালিকা করে ফেলতে বলা হয় তবে, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন’ সম্ভবত তার মধ্যে প্রথম দিকেই থাকবে। আমার সাথে নিশ্চয়ই যে কেউ একমত হবেন যে, বছর বছর তাপমাত্রা বেড়ে চলাটা অস্বস্তির একটা গুরুতর কারণ হয়েই দাঁড়াচ্ছে। এখন আপনাকে যদি এই উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণগুলো জিজ্ঞাসা করা হয় তবে এর মধ্যে প্রথমেই আসবে ধোঁয়ার কথা, সে গাড়িরই হোক কিংবা শিল্পকারখানার। আরও স্পষ্ট করে বললে এই অস্বস্তির মূল কারণ হিসেবে মূলত ‘গ্রীনহাউজ ইফেক্ট’ই দায়ী।

‘গ্রীনহাউজ ইফেক্ট’ ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ‘গ্রীনহাউজ’ মূলত একটি ‘কাঁচের ঘর’। এই কাচের ঘরটা কিন্তু সারাবিশ্বে দেখা যায়না। এটা মূলত শীতপ্রধান দেশে জনপ্রিয় কারণ, সেসব দেশে উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা কঠিন। শীতপ্রধান দেশে মুলত বীরুৎ, গুল্ম আর ছোট ছোট বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ চাষ করার জন্য কাঁচের তৈরি ঘরে সংরক্ষণ করা হয়। কাঁচের একটা বৈশিষ্ট্য হল তা ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ এর ভিতর দিয়ে যেতে দেয়, কিন্তু বৃহৎ বিকিরণ যেতে দেয়না। শীতপ্রধান দেশে দিনে সূর্যের বিকিরিত ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মি কাঁচ ভেদ করে ঘরের ভিতর চলে যায় এবং উদ্ভিদ্গুলোকে উষ্ণ করে। কিন্তু উষ্ণ উদ্ভিদগুলো যখন বৃহৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাপ বিকিরণ করে তখন তা কাঁচ ভেদ করে বাইরে যেতে পারেনা, ফলে উদ্ভিদ্গুলো উষ্ণ থাকে।

‘গ্রীনহাউজ’ শব্দটি বিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্টদের খুবই পরিচিত একটা ব্যাপার। যারা এই ব্যাপারটি এখনও জানেননা তাদের অনেকেই হয়ত ভাবছেন, “গ্রীনহাউজের সাথে তাহলে বৈশ্বিক উষ্ণতার সম্পর্ক এল কোত্থেকে?” আসলে কার্বন ডাই অক্সাইড হল প্রধান গ্রীনহাউজ গ্যাস যেটা গাড়ি কিংবা বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত হয়ে বায়ুমন্ডলে গিয়ে জমা হচ্ছে। এর সাথে আরও জমা হচ্ছে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সিএফসি (ক্লোরো ফ্লুরো কার্বন) এর মত বিষাক্ত গ্যাসগুলো। এরা বৈশিষ্ট্যগতভাবে অনেকটা কাঁচের মতই অর্থাৎ, সূর্যের বিকিরণ সে ঠিকই পৃথিবীতে আসতে দিচ্ছে কিন্তু বেরোতে দিতেই নারাজ। এর ফলে তাপ আটকা পরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, আর হাঁসফাঁস করছি আমরা। আর এই কাঁচের মত বৈশিষ্ট্যের কারণে এদের ‘গ্রীনহাউজ গ্যাস’ ডাকা হয়।

এই গ্যাসগুলো যেসব জায়গা থেকে নির্গত হচ্ছে সেগুলোকে প্রধানত পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে ‘পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (ইপিএ)’। সেগুলো হল- বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি বাণিজ্য, ব্যবসায়িক এবং গৃহস্থালীর কর্মকান্ড। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান পরিবহন, বিদ্যৎ উৎপাদন এবং শিল্প কারখানাগুলোর। এক চীনই বিগত বছরে গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করেছে ৯.৭ বিলিয়ন মেট্রিক টন! এই পরিমাণ পুরো বিশ্বের মোট নিঃসরণের প্রায় ২৭ শতাংশ! ৫.৬ বিলিয়ন মেট্রিক টন নিয়ে দুইয়ে আমেরিকা। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী গ্রীনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১.২ শতাংশ এবং ২০১৫ তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২.৫ শতাংশে! বর্তমানে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৪০০ পার্টস পার মিলিয়ন যা বিগত আট লক্ষ বছরের ভিতর সর্বোচ্চ।

এবার তাহলে আসল কথায় আসি। গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে জীবাশ্ম জ্বালানী চালিত যানবাহনগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এবার গবেষকরা একটু অন্যভাবে ভেবেছেন। তারা ব্যাটারীচালিত সংকর যানবাহনের পরিমাণ বাড়ানোর কথা ভাবছেন। বৈশ্বিক উষ্ণতার এমন দ্রুতগতির উত্থান যখন আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন তাদের কিছুটা অন্য রাস্তায় ভাবতেই হত যেটা একইসাথে যুগপোযোগী। এক্ষেত্রে অবশ্য তারা ভেবেছেন লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীর কথা যে ধরনের ব্যাটারী ব্যবহৃত হয় বহনযোগ্য ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী যেমন- স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদিতে। লিথিয়াম ব্যাটারি অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে জন্যই এটি দৃশ্যপটে, যদিও ধারণাটি অনেক পুরোনো। ২০২০ সালের ভিতর প্রায় ২০ মিলিয়ন লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী সংযোজিত গাড়ি রাস্তায় নামানোর কথা ভাবা হচ্ছে যা হতে কোন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ হবেনা। তবে এর অন্যান্য পরিবেশগত দিকগুলো বিবেচনায় আনা হয়েছে কিনা সেটা চিন্তার বিষয়।

লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী মূলত ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার উভয়ের জন্য সন্নিবেশ প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে লিথিয়ামকে আধান পরিবাহক হিসেবে ব্যবহার করে। সন্নিবেশ বিক্রিয়া হল, যে বিক্রিয়ায় কোন অণু নিজেকে অন্য পদার্থের মাঝখানে সন্নিবিষ্ট করে। এক্ষেত্রে লিথিয়াম আয়ন নিজেকে অন্য পদার্থের মাঝখানে সন্নিবিষ্ট করে। চার্জ গ্রহনের সময়্ ক্যাথোড লিথিয়াম আয়নকে অ্যানোডের দিকে ছেড়ে দেয় এবং চার্জ ত্যাগের সময় লিথিয়াম আয়ন অ্যানোড থেকে ক্যাথোডের দিকে ধাবিত হয়।

লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী চালিত যানবাহনগুলো গ্রীনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ একদম নূন্যতম পর্যায়ে নিয়ে আসবে। এছাড়া লিথিয়াম নিজেও পরিবেশের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। এছাড়া এই ব্যাটারীচালিত গাড়ির বেগ ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১২০ মাইল পর্যন্ত তোলা সম্ভব। লিথিয়াম ব্যাটারীতে ব্যবহৃত লিথিয়াম পুনঃপুনঃ ব্যবহারযোগ্য।

তবে লিথিয়াম নিজে ক্ষতিকর না হলেও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীতে ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদানগুলো কতটা পরিবেশবান্ধব সেটা অবশ্যই বিবেচনাধীন হওয়া উচিত। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীর ব্যবহারে গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমলেও অন্যান্য দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবেশ। মাটি দূষণ, পানি দূষণ, পরিবেশের পুষ্টি উপাদান হ্রাস, প্রাণিদের স্বাস্থ্যের অবনতি এবং পরিবেশের বিষাক্ততা বৃদ্ধিতে এটি রাখবে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভূমিকা।

কীভাবে? বিস্তারিত আলোচনা আসছে দ্বিতীয় পর্বে…

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading