বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী! (শেষ পর্ব)

দিব্য কান্তি দত্ত

গত পর্বে কথা হয়েছিল, বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীর অবদান সম্পর্কে। গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়া কমাতে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী যুগপোযোগী এবং অত্যন্ত কার্যকরী অবদান রাখবে। তবে শুধুমাত্র গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়া কমাতে এই ব্যাটারীচালিত সংকর যানবাহনের কথা ভাবতে গিয়ে আমরা অন্যান্য পরিবেশগত দিক নিয়ে ভাবতে ভুলে যাচ্ছি কি না- সে নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কারণ, এক গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়া থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে গিয়ে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হবে স্থলজ ও জলজ পরিবেশ এবং সেইসাথে সেখানকার জীবগুলোকে! লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীতে শক্তি উৎপাদনের জন্য সাধারণত তড়িৎদ্বার হিসেবে ব্যবহার করা হয় অ্যালুমিনিয়াম এবং কপার। এ দুটো মৌলেরই প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় এদের খনি। ২০২০ সালের মধ্যে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী সম্বলিত ২০ মিলিয়ন সংকর যানবাহন রাস্তায় নামানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ, এই বিপুল পরিমাণ যানবাহনের জন্য উৎপন্ন করতে হবে বিপুল পরিমাণ ব্যাটারী এবং এজন্য খনি থেকে উত্তোলন করতে হবে প্রচুর পরিমাণ অ্যালুমিনিয়াম এবং কপার। এই বিপুল পরিমাণ অ্যালুমিনিয়াম এবং কপার খনি থেকে ঘন ঘন উত্তোলন করার ফলে এই উত্তোলন প্রক্রিয়ায় বিষাক্ত পদার্থ নির্গমনে দূষিত হবে বায়ু, মাটি এবং পানি। এছাড়া অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য তখন এই ধাতুগুলো হয়ে পড়বে দূর্লভ। এ তো গেল শুধুমাত্র খনি থেকে সৃষ্ট দূষণের কথা। গুরুতর বিষয় নিয়ে এখনো আলোচনায় আসাই হয়নি!

71a0028b-05d9-43ca-9153-44107e32a82a

‘উইসকন্সিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়’র গবেষকদের গবেষণায় উঠে এসেছে, কিছু যানবাহন এবং বহনযোগ্য ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীতে ব্যবহৃত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী মাটির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকটেরিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং কমিয়ে দিচ্ছে এর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা। ‘Chemistry of Materials’ জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়, “লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীর মূল উপাদানগুলো Shewanlla oneidensis ব্যাকটেরিয়াটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং এর কারণে তা মাটির অন্যান্য অণুজীবগুলোকে সঠিকভাবে পুষ্টি সরবরাহ করতে পারছে না”। Shewanlla oneidensis ব্যাকটেরিয়াটি সর্বপ্রথম ১৯৮৮ সালে ‘ওনাইডা লেক’ থেকে আবিষ্কার করা হয় এবং এই কারণে ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কৃত প্রজাতির নামকরণেও লেকের নামের প্রভাব লক্ষণীয়। ব্যাকটেরিয়াটির শ্রেণিবিন্যাসটা এরকম-

Kingdom: Bacteria
Phylum: Proteobacteria
Class: Gamma Proteobacteria
Order: Alteromonadales
Family: Shewanellaceae
Genus: Shewanella
Species: Shewanella oneidensis

এটি সর্বব্যাপী এবং পুরো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ অণুজীব। ব্যাকটেরিয়াটি  অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এবং  অনুপস্থিতিতে, এই দুই অবস্থাতেই নিজেদের কার্য সম্পাদন করতে পারে। একে মাটির মূল অণুজীব হিসেবে বিবেচনা করা হয় এর বহুমুখীভাবে ইলেকট্রন গ্রহণের অনন্য ক্ষমতার জন্য। এজন্য একে ‘বায়োরিমিডিয়েটর’ ও বলা হয়ে থাকে। ‘বায়োরিমিডিয়েটর’ হল যারা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পরিবেশ থেকে অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলো অপসারণ করে। ‘বায়োরিমিডিয়েটর’ হিসেবে এটি পরিবেশ থেকে শুধু অপ্রয়োজনীয় অপদ্রব্যই অপসারণ করেনা, বিভিন্ন ক্ষতিকর ধাতু এবং ধাতব উপাদানকে বিভিন্ন অণুজীবের জন্য পুষ্টি উপাদানেও রূপান্তরিত করে! তাদের বিচিত্র বিপাকীয় ক্ষমতার কারণে তারা কার্বন চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পরিবেশের বিভিন্ন দূষিত উপাদানকে অন্যান্য অণুজীবের বিপাকীয় কাজে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার ক্ষমতাও তাদের বিদ্যমান।

acc8782c-c196-4893-ad7f-61f7a128e3c1

সিগনাল ট্রান্সডাকশন প্রোটিন, শ্বসন এবং বিপাকের বিভিন্ন ধরনের উপ-পদ্ধতি এই উল্লেখযোগ্য বহুমুখীতার জন্য দায়ী। এখন ‘উইসকন্সিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ‘মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়’র গবেষকরা খেয়াল করেছেন যে, ন্যানোস্কেল যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধিতে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারী থেকে নির্গত উপাদানগুলো পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ‘উইসকন্সিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়’র রসায়নের অধ্যাপক এবং গবেষক দলের প্রধান রবার্ট জে. হ্যামারসের ভাষ্যমতে, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীর প্রযুক্তির জন্য ব্যবহৃত নিকেল ম্যাঙ্গানিজ কোবাল্ট অক্সাইড (এনএমসি) নামের যৌগটি দ্রুতই মাটির উপাদানগুলোর সাথে মিশে যাচ্ছে এবং ব্যাকটেরিয়াটিকে প্রভাবিত করছে।

2eaf3385-a4e4-47ad-8bfe-c58e239fd96b

এনএমসি এবং অন্যান্য ধাতব অক্সাইডগুলো ন্যানোস্কেলে তৈরি করা হয় এবং ব্যাটারীতে শক্তি সংরক্ষক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পদার্থগুলো তৈরির উপাদানগুলো সস্তা তবে খুবই ক্ষতিকর। নিকেল, কোবাল্ট এগুলো ‘ডার্ট চিপ’ হিসেবে ব্যাটারীতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো শক্তি সঞ্চয়ের জন্য যতটা ভাল ঠিক ততটাই বিষাক্ত। হ্যামারস এবং তার দলের অন্য দুই সদস্য হ্যানেস এবং পেডারসেন উক্ত ব্যাকটেরিয়ার ওপর এনএমসি এর প্রভাব পরীক্ষা করেন। হ্যানেসের ভাষ্যে, “Shewanella একইসাথে ‘বিষাক্ততা নির্দেশক’ এবং ‘বায়োরিমিডিয়েটর’। আমাদের গবেষণা মূলত নিঃসরিত ন্যানোম্যাটেরিয়াল এর ওপর কতটা প্রভাব ফেলে তার ওপর। যখন এরা এনএমসি এর আওতায় আসে তখন এদের বৃদ্ধি এবং শ্বসন হার কমে যায়। আমরা এই বিষয়টা নিয়ে আরো গভীরে যেতে চাই এবং জিনগত আচরণকে এই উপাদানগুলো কতটা প্রভাবিত করে তা নির্ণয় করতে চাই”। তাদের মতে, শুধুমাত্র কিছু বাস্তুসংস্থানিক এলাকার ব্যাকটেরিয়ার ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে পুরো পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানিক এলাকা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেয়াটা উচিত নয়। তবে এটা প্রথম বিপদসংকেত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

লেড ব্যাটারী বিবেচনায় আনার মত যথেষ্ঠ ভাল অবকাঠামো অনেক দেশেরই আছে বলে মনে করেন গবেষণা দলের প্রধান। লিথিয়াম ব্যাটারী তৈরিতে খরচ কম তবে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনঃব্যবহারের অযোগ্য। এছাড়া প্রতিটা যানবাহন ৭৫-৮০ পাউন্ড ধাতব অক্সাইড বহন করবে যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এর ফলে মাটিতে এবং পানির তলদেশে থাকা Shewanella বিষাক্ত পদার্থকে পুষ্টি উপাদানে পরিণত করতে অক্ষম হয়ে পড়বে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিভিন্ন জলজ ও স্থলজ অণুজীব, উদ্ভিদ এবং প্রাণী। এ বিষয়ে হ্যামারস বলেন, “ আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য এমন কোন পদার্থ তৈরি করা যা পরিবেশের জন্য অনুকূল এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকেও কার্যকর। তবে আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে অপেক্ষা করছে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীকে উৎপাদনশীল জমি থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা যাতে তা জমিতে বিষাক্ত পদার্থ ছড়িয়ে দিতে না পারে”।

সংকর যানবাহনের হাতে কতটা নিরাপদ আমাদের পরিবেশ? নিরাপত্তা প্রদান করা হয়তো বা সম্ভবপর হবে, যদি না সঠিক ব্যবস্থাপনায় এবং সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে এদেরকে সত্যিকার অর্থেই যুগোপযোগী করে তোলা যায়!

Check Also

মস্তিস্ক ভক্ষক অ্যামিবা !

এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে অনেক ঔষধ  Naegleria fowleri  (নেগেইলারিয়া ফাউলিরি) এর বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে, তাদের কার্যকারিতা অস্পষ্ট; কারণ প্রায় সব সংক্রমণই মরণঘাতি।

অসাধু ব্যবসায়ীক চক্রেই ভেজাল ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা সাধারণ

পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট এর ফল পরীক্ষার তথ্যানুযায়ীই বলতে হয় যে, এ দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল এবং দেহের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর বলেই চিহ্নিত হয়েছে। সারা দেশ থেকেই স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্য দ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *