পাহাড় ডাকে অবিরাম…

তানভির আহমেদ রিশাত

একটা সময় ছিল যখন মনে করতাম সাগরের মত হয়তো সুন্দর আর কিছুই নেই। একবার হঠাৎ করেই সুযোগ এল পাহাড়ে যাওয়ার।

গন্তব্য, চট্টগ্রামের মীরেরসরাই এর বেশ কিছু পাহাড় ও ঝর্না। ট্রেকিং কী তাও বুঝতে পারি প্রথম এই ট্যুরেই। কারো প্রথম ট্রেকিং হিসেবে মীরেরসরাই সর্বোত্তম! কষ্ট কম, দেখার মত স্থানের পরিমান বেশি, সময়ও লাগে তুলনামূলক কম।

প্রথমবার গিয়েই পাহাড়ের নেশায় পড়ে গেলাম। এ এক অন্যরকম নেশা। এ নেশায় ধরলে পাহাড় ছেড়ে বেশিদিন থাকা যায় না।

পাহাড়ে গিয়ে কমপক্ষে কয়েকশ’বার বলি,”আর জীবনেও পাহাড়ে আসব না।“ কিন্তু সত্যি কথা বলতে কথাটা আমি পরে রাখতে পারিনা। যখন পাহাড় থেকে ফিরে আসতে থাকি, তখন আক্ষরিক অর্থে পাহাড়ের ডাক শুনতে পাই আমি। ফিরে আসার পর বেশ কিছুদিন ঝিম মেরে থাকতে হয়। মনে হয় কী যেন একটা ফেলে এসেছি ঐ সবুজ পাহাড়গুলোতে।

কিন্তু কেন যাই আমি পাহাড়ে? কী দিতে পারে পাহাড়? কী আছে ওখানে? উত্তরগুলো হয়তো অনেকটা এরকম…

তাজিংডং এর চূড়া থেকে !
তাজিংডং এর চূড়া থেকে !

১. অকল্পনীয় কষ্টসহিষ্ণু করে তুলতে পা্রে !

ট্রেকিং আপনাকে যে শুধু শারীরিকভাবে কষ্টসহিষ্ণু করে তুলবে তাই নয়; ট্রেকিং আপনাকে দিতে পারে একটি সঠিক খাদ্যতালিকা। পাহাড় ট্রেকে যাওয়ার আগে আপনাকে নিজের জন্য বেশকিছু খাবার সাথে করে নিয়ে যেতে হয়। নিজেই আবিষ্কার করবেন ট্রেইলে,অস্বাস্থ্যকর খাবার আপনার শরীরের জ্বালানীর চাহিদা পূরন করতে পারছে না। একসময় আপনার খাদ্যতালিকা থেকে সকল ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবার বাদ পড়ে যাবে।। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে আপনি একসময় অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন।

পাহাড়ে উচ্চতা অনেক বড় একটা বিষয়। পাহাড়ের উচ্চতা আপনার ফুসফুসকে আরো বেশি শক্তিশালি করে তুলবে। যতবেশি ট্রেকিং এ যাবেন তত বেশি দেখবেন আপনার কষ্ট কম হচ্ছে পূর্বের যে কোন ট্রেকিং থেকে।

২. অসাধারন সব স্থান দেখতে পারবেন !

আমরা সবাই কমবেশি পাহাড়ের ছবি দেখে থাকি এবং মনে মনে ইচ্ছা করে আমাদের,”যদি ওখানে যেতে পারতাম!” কিন্তু এই “যেতে পারা” ব্যাপারটা সবার দ্বারা হয়ে উঠে না। ট্রেকিং বেশ কঠিন একটা কাজ যা অনেকেই করতে চায় না বা করতে চাইলেও কষ্ট দেখে পিছপা হয়ে যায় একসময়। ট্রেকিং এ যান, ঘন্টার পর ঘন্টার চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠুন, নিশ্চিত থাকতে পারেন আপনি হাতে গোণা কিছু মানুষের একজন যারা এমন কোন দূর্লভ দৃশ্য দেখতে পেয়েছে! আর ১০০% নিশ্চয়তা দেয়াই যায় পাহাড়ের ব্যাপারে যে, প্রতিটি পাহাড়ের চূড়া থেকে আপনি অবশ্যই কিছু অভাবনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারবেন!

৩.অসাধারন কিছু বন্ধু পাবেন !

ট্রেকাররা সাধারনত মানুষ হিসেবে ভাল ও উদারমনা হয়ে থাকেন। তাঁদের সবার মধ্যেই কিছু কিছু ব্যাপারে কমবেশি মিল খুঁজে পাবেন আপনি। তাঁরা সকলেই আশাবাদী, শক্ত-সমর্থ ও আত্মবিশ্বাসী। সর্বোপরি তাঁরা সকলে সবসময় সুখি! ট্রেকারস বা হাইকারস- তাঁদের ব্যাপারে  সবথেকে ভাল লাগার যে একটি বিষয় তা হল তাঁরা সকলেই একটি মাত্র উদ্দেশ্যে কাজ করে থাকে। আর তা হল অজানাকে জানা এবং অদেখাকে নিজের মত করে দেখা!

সাকার চূড়ায়; অকৃত্রিম বন্ধু অং ফ্রু খিয়াং-এর সাথে লেখক
সাকার চূড়ায়; অকৃত্রিম বন্ধু অং ফ্রু খিয়াং-এর সাথে লেখক

৪. আপনি একসময় বুঝতে পারবেন কেন পাহাড়ের ডাক শোনা যায় !

প্রতিটি পাহাড়ই নিজের মধ্যে কিছু না কিছু জাদু লুকিয়ে রাখে। এটাকে আমাদের এতটা মোহনীয় লাগে হয়তো এজন্য যে, পাহাড় যেকোন সময়েই বিপজ্জনক হতে পারে কিংবা হয়তো এজন্য যে, পাহাড় আমাদের মনে নিদারুন এক বিশালতার জন্ম দেয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রথম মনে হবে, এই বিশাল ব্রহ্মান্ডে আপনি খুব তুচ্ছ কিন্তু চট করেই এই ধারণা থেকে বের হয়ে দেখবেন, মনের দরজাগুলো এক এক করে খুলে যাচ্ছে। তখন অদ্ভুত এক বিশালতায় আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন !

এমনকি আপনি যদি পাহাড়ে নাও উঠে থাকেন তারপরেও আপনার কাছে মনে হতে পারে পাহাড় বুঝি সত্যিই আপনাকে ডাকছে! পাহাড়ে  গিয়ে হয়তো কখনও আপনি আপনার জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান পেয়ে যেতে পারেন কিংবা এমন হতে পারে যে পাহাড়ে যাওয়ার পর তার সমাধান নিজ থেকেই হয়ে যাচ্ছে!

কেওক্রাডং এর চূড়ায়...
কেওক্রাডং এর চূড়ায়…

৫. পাহাড় আপনাকে শিক্ষা দেয় ধৈর্য,একাগ্রতা এবং মূল্যবোধের !

পাহাড়ে চড়া বেশ কষ্টসাধ্য একটি কাজ। এটি যে আপনার কেবল শারীরিক পরীক্ষা নিবে তা-ই নয়, পাহাড় মানসিক শক্তি এবং ধৈর্যেরও পরীক্ষা নিতে পারে। পাহাড় সম্পর্কে বেশ সুন্দর একটা কথা প্রচলিত আছে,”পুরো পাহাড়কে কখনও একসাথে দেখতে যেও না। নির্দিষ্ট সময়ে এর কিছু নির্দিষ্ট অংশ বিচার করে পথ চল।“ পাহাড় ট্র্যাকে আপনি শিখবেন কীভাবে হাল না ছেড়ে আরো সামনে এগিয়ে যেতে হয়; শিখবেন কষ্টের মূল্যায়ন করতে। এ এক অন্যরকম নেশার অনুভূতি। যা কেউ কখনও ব্যাখ্যা করতে পারবে না; পারবে কেবল উপলব্ধি করতে।

৬. পাহাড় আপনাকে শিক্ষা দিবে কেন আমাদের প্রকৃতিকে সংরক্ষন করা উচিত !

ট্রেকিং-এ গেলেই আপনি দেখতে পাবেন অন্যরকম এক বন্য ও আদিম সৌন্দর্য। যেখানে মানুষের করাল থাবা এখনও পড়েনি। স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনে হবে এই পরিবেশকে এইভাবেই অকৃত্তিম করে রেখে দিতে। আপনি বুঝবেন পরিবেশের গুরুত্ব।

৭.প্রতিটি পাহাড় যেন একেকজন শিক্ষক!

আমি প্রতিটা ট্রেকিং-এ পাহাড়ের কাছ থেকে নতুন কিছু না কিছু শিখে থাকি। যেমন আমার প্রথম ট্রেকিং-এ শিখেছিলাম দুই ফিতার স্লিপার স্যান্ডেল পাহাড়ে আপনার মরণ ডেকে আনতে পারে! আবার পরের ট্রেকিং-এই বুঝেছিলাম পাহাড়ে আপনার ক্যামেরার জন্য একটা ব্যাগ থাকা আবশ্যক! যাই হোক না কেন, প্রতিটি ট্রেকিং-এই নতুন কিছু না কিছু শিখবেন আপনি; যাই ঘটুক না কেন!

৮. প্রকৃতির খুব বেশি কাছে যাওয়া !

পাহাড়ের মধ্যে  একবার হারিয়ে গেলে প্রকৃতির এত কাছে যাওয়া যায়,যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। চারিদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। জ্যোৎস্না রাত কিংবা অন্ধকার আকাশে তারার খেলা-সবকিছু পুরোপুরি উপভোগ করা যায় একমাত্র পাহাড়ের গহীনে। পাহাড়ের জ্যোছনায় অন্যরকম এক মাদকতা ! সবকিছু কেমন যেন অপার্থিব লাগে সেই আলোয়। পাহাড়ের বৃষ্টি সবকিছুর উপরে! চারিদিকে সবুজ আর সবুজ.. বিশাল কোন এক পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট একটা জুমঘরে শুয়ে শুয়ে ঝুম বৃষ্টি দেখতে পারলে আক্ষরিক অর্থেই মনে হয় এই মানব জীবন স্বার্থক আমার ! এর জন্যেই আমি বেঁচে আছি !

নেফিউ পাড়ায় যাওয়ার পথে...
নেফিউ পাড়ায় যাওয়ার পথে…

 পরিশেষে, পাহাড় এমনই একটা স্বত্বা যা আপনাকে বার বার ডাকবে আর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আপনি বার বার ফিরে যেতে চাইবেন!

ট্রেকিং-এ যেতে চাইলেঃ

যেহেতু এটি একটি বেশ কষ্টকর কাজ, তাই কিছু পূর্ব প্রস্তুতি দরকার হয়ে থাকে ট্রেকে যাওয়ার আগে। আপনি অবশ্যই আপনার শরীরকে যথাসম্ভব সবল রাখতে চাইবেন।  এজন্য কোন ট্রেকে যাওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই নিয়মিত ব্যায়াম করাটা জরুরি। (যদি আপনার ব্যায়ামের অভ্যাস না থাকে।) প্রচুর পরিমানে পানি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন। হাঁটার অভ্যাস অতি আবশ্যক একটা বিষয়। ট্রেকিং-এ যাওয়ার পর দেখা যাবে অনেক সময় ১২-১৬ ঘন্টার ট্র্যাকও দিতে হতে পারে। হাঁটার অভ্যাস না থাকলে আপনিই বিপদে পড়বেন! ট্রেকিং ব্যাকপ্যাকে যথাসম্ভব কম ওজন চাপাবেন। যাওয়ার আগে অবশ্যই দরকারি ঔষধপত্র (যেমন, প্যারাসিটামল,পেইনকিলার,ব্যান্ড এইড,তুলা ইত্যাদি) নিয়ে নিতে ভুলবেন না। মশা প্রতিরোধের জন্য ওডোমস নিতে পারেন।

ট্রেকিং-এ যাওয়ার পর করণীয়ঃ

ট্রেকিং-এ যাওয়ার পর যে বিষয়টি কোনভাবেই ভুলে যাওয়া চলবে না, তা হল পরিবেশ ও প্রকৃতি। এমন কিছু করা যাবেনা যাতে পরিবেশের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়। প্লাস্টিকের কোন খোলস কোন অবস্থাতেই ট্রেইলে ফেলা যাবেনা। পকেটে বা ব্যাকপ্যাকে রেখে দিবেন, গন্তব্যে পৌছানোর পর নষ্ট করবেন। ওপেন এয়ার টয়লেটে মানিয়ে নিতে হবে নিজেকে। চলার সময় সাবধানতার সাথে পথ চলবেন। কোন অবস্থাতেই কোনপ্রকার অযথা ঝুঁকি একেবারেই বর্জনীয়। পাহাড়ে সামান্য একটু অসাবধানতাও বড় বিপদের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।

নিজেকে প্রস্তুত করুন। প্রকৃতিকে জানার, অদেখাকে দেখার আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে সম্পূর্ণ নতুন এক অজানা রোমাঞ্চকর পৃথিবী ! ট্রেকিং জগতে স্বাগতম আপনাকে। হ্যাপি ট্রেকিং !

সাকা জয় !
সাকা জয় !

লেখক;
শিক্ষার্থী;
মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ ( সম্মান-৩য় বর্ষ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Check Also

মস্তিস্ক ভক্ষক অ্যামিবা !

এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে অনেক ঔষধ  Naegleria fowleri  (নেগেইলারিয়া ফাউলিরি) এর বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে, তাদের কার্যকারিতা অস্পষ্ট; কারণ প্রায় সব সংক্রমণই মরণঘাতি।

অসাধু ব্যবসায়ীক চক্রেই ভেজাল ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা সাধারণ

পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট এর ফল পরীক্ষার তথ্যানুযায়ীই বলতে হয় যে, এ দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল এবং দেহের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর বলেই চিহ্নিত হয়েছে। সারা দেশ থেকেই স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্য দ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *