কিশোর-তরুণদের বিপথগামীতা থেকে ফিরাতে প্রকৃতিসম্মত মনোসামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত করার আহবান

বিশ্বব্যাপী এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দযুগল হচ্ছে ‘সন্ত্রাস’ এবং ‘সন্ত্রাসী হামলা’; ১৫ জুলাই ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহ ফলাফল আমরা অতীব বেদনা ও তীব্র ঘৃণার সাথে প্রত্যক্ষ করেছি। বাংলাদেশেও এই বর্বর ঘটনার শুরু হয়েছে গত শতাব্দীর শেষ দশক হতে। বিগত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারীতে এবং ৭ জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাতের সন্নিকটে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলায় দেশবাসী হতবিহ্বল এবং আতংকিত। আরো শিউরে ওঠার মতো বিষয় হচ্ছে এ দুটো সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নেয়া সন্ত্রাসীদের মধ্যে যারা নিহত হয়েছে তারা সকলেই কিশোর-তরুণ।

দেশের কিশোর-তরুণদের যেখানে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার কথা সেখানে তারা বিপথগামী হচ্ছে। তারা ঝুঁকে পড়ছে সন্ত্রাণবাদের দিকে। ফলে দেশ এবং জাতি যেমন অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তেমনি ঝরে যাচ্ছে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণ। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এই কিশোর-তরুণদের বিপথগামীতা থেকে রক্ষা করা। এবং এটাই হবে সন্ত্রাসকে মুলোৎপাটনের মৌলিক কাজ। একটি শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ সংগঠনের সুস্থ ও এবং প্রকৃতিসম্মত পরিবেশ। কিশোর-তরুণদের বিপথগামী থেকে ফেরাতে প্রকৃতিসম্মত মনোসামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর আয়োজনে আজ ১৬ জুলাই ২০১৬, সকাল ১১টায়, পবা কার্যালয়ে ‘‘বিপথগামী কিশোর-তরুণ ও মনোসামাজিক পরিবেশ” শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।poba-nature-friendly-society

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজী বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল, এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান সাগর প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, আমাদের পারিবারিক, সামাজিক জীবন ক্রমাগত অস্থির হয়ে পড়ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সামাজিক পরিবেশের অবক্ষয় হচ্ছে, আমরা সজ্ঞানে বা না জেনে এই পরিবেশ ধ্বংসকে ত্বরাণি¦ত করছি। তরুণ-কিশোরদের বিপথগামী হওয়ার পিছনে এটাও একটি অন্যতম কারণ। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায় প্রায় দুইশত কিশোর-তরুণ নিখোঁজ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এদের অধিকাংশ ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে যোগ দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে আসে নাই সে সংখ্যাটিও বেশ বড়ো বলে মনে করা হচ্ছে। এই সব কিশোর-তরুণদের বিপথগামী করে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীতে রূপান্তিত করা হচ্ছে। তারা আত্মঘাতী হামলাকারী হয়ে যাচ্ছে। মগজ ধোলাই দেয়ার সাথে সাথে বোধবুদ্ধি বিলোপকারী ভয়ংকর নেশা তৈরিকারী ঔষধ দিয়ে এইসব কিশোর*তরুণদের মানব রোবটে পরিণত করা হচ্ছে। এই মানব রোবটেরা হাসিমুখে একের পর এক মানুষকে ধারালো ছুরি দিয়ে হত্যা করতে পারে। গুলশানের ঘটনায় আমরা দেখেছি বিশজন মানুষকে হত্যার পর সেই রক্তপ্লাবিত ঘরে বসে বিশটি মৃতদেহের সামনে তারা অবলীলায় খাবার খেয়েছে। এই বিষয়গুলো সবার সাথে আমাদেরকেও আতংকিত করেছে। আমরা মনে করি সন্ত্রাসীদের হত্যা করে বা জেলে ঢুকিয়ে এই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান সম্ভব নয়। সমস্যার মূল উৎপাটন করতে হলে অপরাধীদের বিচারের সাথে সাথে যে সব মনোসামাজিক কারণে কিশোর-তরুণেরা বিপথগামী হচ্ছে সেগুলো খুঁজে বের করে তার সমাধান করতে হবে।

সভ্যতা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে কিশোর-তরুণদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। আমাদের প্রতিবেশি ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের প্রায় ৬০% করে থাকে ১৬-১৮ বছর বয়েসীরা। আমেরিকার জুভেনাইল জাস্টিস অ্যান্ড ডেলিকুয়েন্সি প্রিভনেশন অফিস মনে করছে কিশোর তরুণদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।

একটি শিশুর বিকাশের প্রধান পীঠস্থান হচ্ছে তার পরিবার। পরিবারে মা-বাবা যদি শিশুর বিকাশ সম্পর্কে আবেগ, মন ও ধারণাগতভাবে অপরিপক্ক থাকে তাহলে সেই পরিবারে শিশুর বিপথগামিতার সম্ভাবনা অধিকতর। এছাড়া বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের অসদাচারণ, মিথ্যাচার, দূর্নীতিপরায়ণতা, ভারসাম্যহীন ব্যবহার শিশুকে বিপথগামী করে তোলে। প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজন দ্বারা শিশুরা দারুণ প্রভাবিত হয়। স্কুল-কলেজ হচ্ছে শিশু কিশোরের অনন্য ভুবন। এখানে লেখাপড়ার সাথে সাথে শিশূ কিশোরদের সামাজিকীকরণ হয়। এখানে সহপাঠি, বন্ধু, শিক্ষক দ্বারা ব্যক্তি শিশু বা কিশোরটি খুব বেশি প্রভাবিত হয়। কিশোর তরুণটির জীবনপথের গতিমুখ নির্ধারণে এদের যে কেই নির্ধারক ভ’মিকা পালন করে। কিশোর বা তরুণ বিপথগামী হওয়ার সুযোগ এখানে বেশি পায়। পিঠে বইয়ের বোঝা বহন করতে করতে শিশুটির পিঠ বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, প্রাইভেট পড়া, পাঠের বোঝা তার জ্ঞান চর্চা ও পড়ার আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে। খেলার মাঠ নেই, নেই বিনোদনের জায়গা। শহরগুলো ইটের বস্তি। বছরের পর বছর কেটে গেছে মাটির সাথে পায়ের স্পর্শ লাগেটি। একটি ঘরের চার দেয়ালের ভিতর শিশু বন্দী। মাথা গুঁজে মোবাইল, ল্যাপটপে ইন্টারনেট সার্চ করে ফেসবুকিং ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম ভ্রমণ করে করে সে ক্লান্ত। সব মিলিয়ে সে হতাশ অথবা ক্ষুব্ধ।

এই তরুণদের এই কিশোরদের আমরা কিভাবে বিপথগামীতা থেকে ফিরাবো ? ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রজীবন পর্যন্ত সদাচারী হতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। সর্বপর্যায়ে শিক্ষা হবে আনন্দময় ও প্রকৃতিসম্মত। শিশুদের জন্য আনন্দের বিনোদনের পর্যাপ্ত আয়োজন রাখতে হবে। খেলার পর্যাপ্ত মাঠ, পার্ক রাখতে হবে। প্রকৃতির বিন্যাসের সাথে সামঞ্জস্য জীবনধারা গড়ে তুলতে হবে। যেসব কারণে শিশুদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও ক্রোধ তৈরি হয় সে কারণগুলো যথাসাধ্য দূর করতে প্রয়াসী হতে হবে। সর্বোপরি শিশু-কিশোর তরুণদের সামনে মানব কল্যাণের স্বপ্ন তুলে ধরে সেই পথে তাকে নিরন্তর ডেকে যেতে হবে। তাহলেই আমাদের কিশোর তরুণেরা বিপথগামী হবে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading