বহুতল ভবন, শপিংমল, হাসপাতাল, শিল্পকারখানায় অগ্নি নির্বাপণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি

মহানগরী ঢাকাসহ অন্যন্য শহরে যে হারে স্থাপনার সংখ্যা বাড়ছে ঠিক সে হারই যেন বাড়ছে অগ্নিঝুঁকিসহ নানাবিধ দুর্ঘটনা। বিশেষ করে বহুতল ভবন, শপিংমল, হাসপাতাল, শিল্পকারখানাগুলো অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে আছে। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক স্থাপনা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা- শহরগুলোতে অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত। এক পরিসংখ্যানে বলা হয় ঢাকা মহানগরীতে সংঘটিত মোট অগ্নিকান্ডের বেশির ভাগই ঘটেছে বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে। পরিবেশ ও জননিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে ভবন নির্মাণে দিকনির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না বলে ক্রমশই বাড়ছে এ ধরনের দুর্ঘটনা।
আজ ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ ইং শনিবার, সকাল ১১ টায়, শাহবাগস্থ ঢাবি’র চারুকলা অনুষদের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ মোট ১১টি সংগঠনের উদ্যোগে “বহুতল ভবন, শপিংমল, হাসপাতাল, শিল্পকারখানায় অগ্নি নির্বাপণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার” দাবীতে মানববন্ধনে বক্তারা উল্লেখিত অভিমত ব্যক্ত করেন।

পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে এবং পবা’র প্রোগ্রাম অফিসার তানভীর মাসুম এর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, পবা’র সম্পাদক মাহবুবুল আলম তাহিন, সহ-সম্পাদক মো. সেলিম, স্থপতি শাহীন আজিজ, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ-এর সভাপতি আমিরুল হাসান, সুবন্ধন সামাজিক কল্যাণ সংগঠন-এর সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, বিসিএইচআরডি-এর সভাপতি মাহবুবুল হক, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানত, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি আমিনুর ইসলাম টুরবুস, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি ও পবা’র সদস্য হাজী শেখ আনসার আলী প্রমুখ।

পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান বক্তব্যে বলেন, বহুতল ভবনগুলো প্রায়ই কোনো রকম অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে বহুতল ভবনে আগুন লাগার ঘটনা বাড়ছে। বহুতল ভবনের নিরাপত্তা এবং অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা সুরক্ষিত করা গেলে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে ঢাকা ও চট্রগ্রামে কমপক্ষে ১৫১৩ টি বহুতল ভবন অত্যধিক আগুন ঝুঁকিতে রয়েছে। অনেক ভবন মালিক নির্মাণের পূর্বে ফায়ার সার্ভিসের এনওসি গ্রহণ করলেও নির্মাণকালে তা বাস্তবায়ন করেন না। এছাড়াও তিনি সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বনানী হরাইজন, গুলশান-১ ডিএনসিসি মার্কেটের অগ্নিকান্ডের কথা উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন বৈদ্যুতিক শট সার্কিটই এসব অগ্নিকান্ডের মূল কারণ।

পবা’র সম্পাদক মাহবুবুল আলম তাহিন তার বক্তব্যে বলেন, সংশ্লিষ্ট নগর কর্তৃপক্ষকে অগ্নিকান্ডের মতো ভয়াভয় দুর্ঘটনা মোকাবেলায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেই সাথে জনসাধারণকে অগ্নিকান্ডের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। জনগণের সচেতনতা অগ্নিঝুঁকি কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

অন্যান্য বক্তরা বলেন, বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকতে হবে যেমন বায়ু চলাচল সিস্টেম, বেজমেন্ট মুক্ত রাখা, বেজমেন্ট ও ছাদে জরুরী জলাধার স্থাপন, জরুরী বহির্গমন পথ। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বাংলাদেশে ফায়ার নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং প্রতিনিয়ত উদ্বেগ বাড়ছে। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক স্থাপনা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা এর প্রধান কারণ। এছাড়াও জলন্ত সিগারেট ও দিয়াশলাই, মশার কয়েল, রাসায়নিক বিক্রিয়া, চিমনি থেকে স্পার্ক, ইঞ্জিনের আগুন, বিদ্যুৎচমক, নাশকতা, অত্যধিক তাপ, বয়লার বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ, ইত্যাদিকে বক্তারা অগ্নিকান্ডের কারণ বলে মনে করেন।

সাম্প্রতিক অগ্নি দুর্ঘটনা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ খুববেশি আগুন ঝুঁকি প্রবণ এবং হতাহত প্রতিরোধ ক্ষমতা ও ক্ষয়ক্ষতি সুনিয়ন্ত্রিত নয়। একটি স্থাপনা নিরাপদ করার ক্ষেত্রে সকল স্টেকহোল্ডারের গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রয়েছে। বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেেেয় সাধারণ ভ’লত্রুটিগুলো হচ্ছে নিম্ন মানের উপকরণ, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ ও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব। যা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অগ্নিকান্ড ঘটিয়ে থাকে। ফায়ার রিক্স ইনডেক্স বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশে গড় হচ্ছে ২.৮ (৫ এর স্কেলে), যা অত্যন্ত ভীতিকর অবস্থার ইঈিত করে। দেশে সর্বাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে, এর পরে নির্মাণ খাতে আর তৃতীয় স্থানে রয়েছে অগ্নিকান্ডজনিত মৃত্যু। ফায়ার সেফটি সম্পর্কিত সমস্যা ঃ ভবনের ক্ষেত্রে আইন ও বিধি যথাযথভাবে প্রয়োগের অভাব, প্ল্যানিং নিয়মাবলীর সীমিত অনুশীলন, জনসচেনতা ও প্রশিক্ষণের অভাব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সক্ষমতার অভাব।

শিল্পকারখানায় দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ- নিয়ম বহির্ভূত নির্মাণ, জরুরি নির্গমন পথ বন্ধ বা দখল করে রাখা, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র না থাকা, ড্রিল না করা, সরু ও অপর্যাপ্ত সিড়ি, নিয়ম বহির্ভূত কারখানার ফ্লোর ব্যবহার করা, দুর্বল স্থাপনা। শিল্পকারখানায় উন্মুক্ত করিডোর থাকা প্রয়োজন। উন্মুক্ত করিডোর শুধুমাত্র কর্মদক্ষতার জন্যই ভাল নয়, তা যেকোন দুর্ঘটনায় বেরিয়ে যাওয়ার জন্যও ভাল। প্রতিটি কারখানা ও স্থাপনায় ঝুঁকি নির্ণয় এবং সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন করা, যেমন-আগুন জ্বলে ওঠার যেকোন উৎস নিরসন করা; কোনো দাহ্য পদার্থ কমানো বা সুশৃঙ্খলভাবে রাখা; পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা; বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা; যেকোন দাহ্য পদার্থ অগ্নি প্রতিরোধক স্থানে রাখা; ধূমপান নিষেধ নীতি সর্বদা চালু রাখা এবং সর্তকতা সংকেত স্থাপন করা; দুর্ঘটনাকালে সকল শ্রমিকের নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার পথ নিশ্চিত করা; অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং নিয়মিত ফায়ার ড্রিল করা; দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ শীতল, বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা সম্পন্ন এলাকায় সংরক্ষণ করা এবং জ্বলে ওঠার সম্ভাব্য উৎস থেকে দূরে রাখা।

ফায়ার-এলার্ম ও যন্ত্রপাতি এবং জরুরি বেরিয়ে যাওয়ার পথ প্রাক-অগ্নি পরিকল্পনার অংশ হওয়া আবশ্যক। ফায়ার-এলার্ম বেজে উঠার সাথে সাথে কোন রকম আতঙ্ক না ছড়িয়ে জরুরি নির্গমন পথে বেরিয়ে যাওয়া এবং সকলের বেরিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করা। আগুন লাগলে তা নিভানোর জন্য যথাযথ অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা। নিয়মিত ফায়ার ড্রিল পরিচালনা এবং তা ফলাফল লিপিবদ্ধ করা। যেমন- ড্রিলের তারিখ, বেরিয়ে যাওয়ার সময়, ড্রিলের ধরন, পর্যবেক্ষণ। এ ফলাফল জরুরি পরিকল্পনা উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

মানববন্ধন থেকে যে সুপারিশগুলো তুলে ধরা হয়ঃ প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণঃ বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ; ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ; আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা; আধুনিক অগ্নিকান্ড সরঞ্জাম যেমন পাম্প, অ্যাম্বুলেন্স, অগ্নিনির্বাপক যানবাহন কেনার জন্য অধিক বরাদ্দ প্রদান ; যেসব এলাকার রাস্তা সরু সেসব এলাকায় ব্যবহারের জন্য কিছু বিশেষ ছোট আকারের যানবাহন সংগ্রহ করা; নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ প্রদান; অগ্নিকান্ডজনিত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে যথাযথ দৃষ্টি দেয়া প্রযোজন।
নগর পরিকল্পনা পরিপ্রেক্ষিত ঃ নগর কতৃর্পক্ষ কর্তৃক প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; সরকার কর্তৃক সরু রাস্তাসমূহ প্রশস্ত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; সরকার কর্তৃক উপযুক্ত ভূমি ব্যবহার জোনিং করা এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা; যেসব এলাকায় প্রাকৃতিক পানির উৎস অত্যন্ত সীমিত সেসব এলাকায় সরকার কর্তৃক সরকারি ভবন ও মসজিদের ছাদে কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ।
ভবনের ক্ষেত্রে ঃ জরুরীভিত্তিতে জরুরী নির্গমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা; পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা; অগ্নিকান্ডের সময় পানির সাহায্যে অগ্নি নির্বাপনে যেসব হুজ পাইপ ব্যবহার করা হবে সেগুলো এমন স্থানে রাখা যাতে অতি সহজেই ব্যবহার করা যায়; পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা রাখা; প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলা; ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ জরুরী সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থার টেলিফোন নম্বর ভবনের বিভিন্ন তলায় বড় করে লিখে রাখার ব্যবস্থা করা; ভূ-গর্ভস্থ পানি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ট্যাংকে বড় ঢাকনি দেয়া ও তা সংরক্ষিত রাখা।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি ঃ অগ্নিকান্ডের সময় অগ্নিকান্ড কবলিত সকলকেই আতঙ্কিত না হয়ে ধর্য্য সহকারে মোকাবেলা করা; লাফ দেয়া ও ভবন বেয়ে নিচে নামা আত্মহুতির সমান তাই তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা; সম্ভব হলে ছাদে চলে যাওয়া। তা সম্ভব না হলে দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করা যাতে ধোঁয়া প্রবেশ করতে না পারে। পরবর্তিতে উদ্ধারকর্মীদের সাহায্য নেয়া;
অগ্নিকান্ডের সময় অগ্নিকান্ড কবলিত জনগন এবং স্থানীয় জনগনের করণীয় বিষয়ে গনমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থা করা; অগ্নি নিরাপত্তা সম্পর্কে অব্যাহতভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এ সমস্যা মোকাবেলা করা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading