হবিগঞ্জ বাঁচাতে খোয়াই নদী রক্ষা ও চলমান শিল্পবর্জ্য দূষণ বন্ধের দাবি

সিলেটে হবিগঞ্জ সমিতির আলোচনা সভায় বক্তারা

হবিগঞ্জ জেলার সার্বিক পরিবেশ­­­-প্রতিবেশ নিয়ে হবিগঞ্জ সমিতি, সিলেট আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, হবিগঞ্জ জেলার পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করতে হলে খোয়াই, সুতাং, করাঙ্গি, নদীসহ অন্যান্য নদী ও জলাশয়ের সুস্থ স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এখনই দখল ও দূষণ প্রক্রিয়া প্রতিরোধে দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে নদীগুলো ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। মাধবপুর, বাহুবল ও হবিগঞ্জে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চলে অপরিশোধিত বর্জ্য পরিশোধন নিশ্চিত করা না হলে বর্জ্যদূষণ আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে। তাই হবিগঞ্জ জেলাকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা করতে হলে দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত হবিগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে করনীয় নির্ধারন করতে হবে। স্বস্ব অবস্থান থেকে পরিবেশসচেতন নাগরিকরা সংগঠিত আওয়াজ উঠালে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ দায়িত্বশীল ভুমিকা পালনে বাধ্য হবে।

গত ১৯ মে শুক্রবার রাতে নগরীর মজুমদারী বিমান ভবনের আইসিসিসিএল সমেলন কক্ষে হবিগঞ্জ সমিতি, সিলেট-এর সভাপতি আবু মোঃ আব্দুল হান্নান-এর সভাপতিত্বে ও মারুফ আহমদ-এর সঞ্চালনায় আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সভাপতি শিক্ষাবীদ অধ্যাপক মোঃ ইকরামুল ওয়াদুদ, মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল কালাম, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারন সম্পাদক আব্দুল করিম কিম, সিলেট জেলে কর আইনজীবী সমিতির সাধারন সম্পাদক আবুল ফজল, বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইন্দ্রানী সেন শম্পা, সাংবাদিক সিদ্দিকী হারুন, হবিগঞ্জ সমিতি, সিলেট-এর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. শওকত হোসেন রিপন, অনুপ কান্তি দাস, প্রমুখ। আলোচনার শুরুতে হবিগঞ্জের খোয়াই নদী, পুরাতন খোয়াই ও শিল্পবর্জ্য দূষণ বিষয়ে ধারণাপত্র ও মাল্টি মিডিয়া প্রেজেন্টেশন প্রদান করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সাধারন সম্পাদক ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল।

ধারনাপত্রে খোয়াই নদী বিষয়ে বলা হয়, খোয়াই নদীর দু’পাশে বাঁধের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর নাব্যতার ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে বিগত কয়েক বছর ধরে খোয়াই ব্রিজের তলায় ও এর আশপাশে পৌরসভার বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর পানি দুর্গন্ধপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়া শহর সংলগ্ন এলাকায় মাইলের পর মাইল নদীর তীর ও নদী অভ্যন্তরে দখল করে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ফলে নদী ও নদীর তীর হয়ে পড়ে গেছে হুমকির মুখে। অনিয়ন্ত্রিত বালু ও মাটি তোলার ফলে এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে গরুর বাজার নৌকাঘাট। শহরের গরুরবাজার এলাকার পশ্চিমদিকে এই নৌকাঘাটটি থেকে আদমপুর, অষ্টগ্রাম, মাদনা, ইকরাম, সুজাতপুর, বাজুকা, চানপুর, কাশীপুর, বুল্লা ইত্যাদি এলাকায় যাত্রী ও মালবাহী নৌকা যেত এবং ওইসব এলাকা থেকে নৌকা আসত। গত ২/৩ বছর ধরে নৌকাঘাটটি বন্ধ। কারণ যে জায়গাটিতে নৌকাঘাট ছিল, খোয়াই নদীর ওই অংশটুকুর গতিপথই বদলে গেছে। গরুরবাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খোয়াই নদীর অংশটি প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে সরে গেছে। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার কারণে এমনটি হয়েছে। 

পুরাতন খোয়াই নদী নিয়ে ধারনাপত্রে বলা হয়, শহরের মাহমুদাবাদ এলাকা থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত নদীটির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে দখলের কারণে। এরপর আধুনিক সদর হাসপাতালের কাছ থেকে দক্ষিণ শ্যামলীর মুখ পর্যন্ত নদীটির অস্তিত্ব কোনরকম টিকে আছে। তবে উভয় পাশেই দখল প্রক্রিয়া চলমান। পুরান মুন্সেফীর পেছন থেকে উত্তর শ্যামলী পর্যন্ত আরেকটি অংশে নদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেটিও উভয় দিক থেকে দখলের মাধ্যমে সংকুচিত করা হয়েছে। বিশেষ করে পুরান মুন্সেফী ও মুসলিম কোয়ার্টারের পেছনে যত বাসা-বাড়ী রয়েছে তাদের প্রায় সকলেই ধীরে ধীরে নদীটির উপরে উঠে আসছেন। এছাড়া কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের সুবিধামত নদীকে ভরাট করে নিজেরদের আয়ত্বে নিয়েছেন। হরিপুর-নাতিরাবাদ অংশে নদীটির অস্তিত্ব একটি মজে যাওয়া খালের মতো। পুরাতন নদীটির শেষ অংশ অর্থাৎ খোয়াই মুখ থেকে বগলা বাজারের মাছ বাজার পর্যন্ত নদীটির বলতে গেলে শুকিয়ে মজে গেছে। এই অংশটিও ক্রমেই দখল হয়ে যাচ্ছে। হবিগঞ্জ শহরের বৃষ্টির পানির প্রধান আধার পুরাতন খোয়াই নদীর অধিকাংশ দখল/ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা বা কৃত্রিম বন্যার।  

হবিগঞ্জে শিল্পবর্জ্য দূষণ বিষয়ে বলা হয়, তিন ফসলি কৃষিজমিতে শিল্প-কারখানা স্থাপন দেশের প্রচলিত নীতি ও আইনবিরুদ্ধ হলেও হবিগঞ্জে কৃষিজমি বিনষ্ট করেই অতি দ্রুততার সাথে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠছে। এধরনের শিল্প-কারখানার ‘উৎসে বর্জ্য পরিশোধন’ ব্যবস্থা না করেই কারখানা চালু করায় শিল্পাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ শুরু হয়েছে । কৃষিজমি, খাল, ছড়া এবং নদীসহ সকল প্রকার জীবন ও জীবিকা শিল্পদূষণের শিকার। কোন কোন এলাকায় হাঁস-মোরগ, গৃহপালিত পশুর মৃত্যুসহ নানা রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। নদী দূষণে মাছের উদপাদন কমে গেছে। নিরাপদ পানির অভাবে অচিরেই মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।

ধারনাপত্রের আলোকে বক্তব্য প্রদানকালে সকল বক্তাই হবিগঞ্জ জেলার পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় হবিগঞ্জে শিল্পবর্জ্য দূষণ বন্ধে ‘উৎসে বর্জ্য পরিশোধন’ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের উপর চাপ প্রয়োগ ও খোয়াই, সুতাং, নদীসহ অন্যান্য নদী ও জলাশয় দখল ও দূষণ প্রতিরোধে সম্মিলিত নাগরিক আন্দোলন ও জনসচেতনতায় একযোগে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading