“দ্যা গ্রেট ডাইয়িং” হারানো প্রাণের ইতিহাস

মোহাম্মদ নায়ীম ইবনুল

পৃথিবীতে প্রাণী কুলের বয়স প্রায় ৩৫০ কোটি বছর। এই কোটি বছরে ৫ টি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হয়। তারমধ্যে সবচে কুখ্যাতটি ঘটে ২৫ কোটি বছর আগে যেটিকে বলা হয় পারমিয়ান মাস এক্সটিংশন বা ‘দ্যা গ্রেট ডাইয়িং’। পারমিয়ান মাস এক্সটিংশন বা ব্যাপক বিলুপ্তির ফলে প্রায় ৯৫ ভাগ জলজ এবং ৭০ ভাগ স্তলজ প্রজাতি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে প্রায় ১০ লক্ষ বছর লাগে প্রাণীজগতের এই হত্যাযজ্ঞের ধাক্কা থেকে আবার উঠে দাঁড়াতে। পারমিয়ান মাস এক্সটিংশনের কারণ তর্কসাপেক্ষ। ভূবিজ্ঞানী এবং জীবাশ্মবিদদের মধ্যে দুটি ধারণা প্রচলিত। প্রথমটি হচ্ছে , বিশাল আকৃতির উল্কার পতন। এই মতবাদের যুক্তি হচ্ছে ৬.৫ কোটি বছর আগের ক্রাটেসিআস এক্সটিংশন যা কিনা ডাইনোসর যুগের বিলুপ্তির কারণ। পারমিয়ান মাস এক্সটিংশনের দ্বিতীয় এবং অধিক গ্রহণযোগ্য মতবাদ হচ্ছে সাইবেরিয়ান ট্র্যাপসের ধারাবাহিক ভলকানিক অগ্ন্যুৎপাত বা ফ্লুইড ব্যাসল্ট। সাইবেরিয়ান ট্র্যাপসের ফ্লুইড ব্যাসল্ট একটি চেইন ইভেন্টের জন্ম দেয় যার ফলাফল হচ্ছে পারমিয়ান মাস এক্সটিংশন। বর্তমান রাশিয়ার অন্তর্গত সাইবেরিয়ান ট্র্যাপসের ফ্লুইড ব্যাসল্ট বা লাভা উদগীরনের সময়কাল ছিল প্রায় ১০ লক্ষ বছর। যার ফলে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের সমান এলাকা লাভায় ঢেকে যায় এবং অবিশ্বাস্য পরিমাণ ছাই আর কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পরে। এক্সটিংশনের প্রথম ধাপ শুরু হয় কার্বন ডাই অক্সাইড দ্বারা যা কিনা স্থলে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বিংশ শতাব্দীর বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড পরিমাণ থেকে ২০ গুণ অধিক কার্বন ডাই অক্সাইড শুরু করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং যা স্থলের সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম ধ্বংস করে দেয়। যার পরিণামে তিন ভাগের এক ভাগ স্থলজ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এক্সটিংশনের পরের ধাপ ছিল আরও সংকটপূর্ণ যা শুরু হয় পারমিয়ান মহাসাগরে। কালপ্রিট আবার কার্বন ডাই অক্সাইড কিন্তু এবার এক দোসর এর সহায়তায়। কার্বন ডাই অক্সাইড হচ্ছে অন্যতম গ্রিন হাউস গ্যাস যা পরিবেশে তাপমাত্রা ধরে রাখে। এর ফলে তৎকালিন পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপামাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বৃদ্ধি ঘটে। এতে পারমিয়ান সাগরের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পায় এবং সাগরে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমতে থাকে যা ছিল জলে এক্সটিংশন বা বিলুপ্তির প্রথম ধাপ। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘাটতি ৯৫ ভাগ জলজ প্রাণী নিধন করার কথা নয়। দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘাটতি আরও একটি চেইন ইভেন্ট এর জন্ম দেয় যার ফলাফল এক্সটিংশনের দ্বিতীয় ধাপ বা কিলিং পিরিয়ড। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে অক্সিজেনের ঘাটতি সাগর তলায় জন্ম দেয় গোলাপি সালফার ব্যাকটেরিয়ার। সালফার ব্যাকটেরিয়ার উপজাত ছিল পচা ডিমের গন্ধ বিশিষ্ট দোসর কালপ্রিট হাইড্রোজেন সালফাইড। এই হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসই ছিল জলে হত্যাযজ্ঞের মুল হোতা। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ অক্সিজেন নির্ভরশীল প্রজাতির মৃত্যু ঘটে হাইড্রোজেন সালফাইডের বিষক্রিয়ায়। দ্বিতীয় ধাপের বিলোপসাধন পর্ব সম্পন্ন হয়।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কাছে মাত্র ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব এত বিশাল হওয়া অস্বাভাবিক ছিল। এবং প্রাপ্ত ফসিলে আরেকটি গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর আলামত ছিল যা ছিল আরও ভয়াবহ। দ্বিতীয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপামাত্রা আরও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বৃদ্ধি ঘটায়। অপরাধীর ছোট লিস্টে যুক্ত হয় আরও একটি গ্রীন হাউস গ্যাস যা কিনা কার্বন ডাই অক্সাইড থেকেও মারাত্মক; মিথেন গ্যাস। পারমিয়ান মহাসাগর এর গভীরে ছিল হিমায়িত মিথেন বা হাইড্রেটেড মিথেনের বিশাল ভাণ্ডার। প্রথম ধাপের ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সাগর তলার এই হিমায়িত মিথেন গলতে শুরু করে এবং পানির চেয় হাল্কা এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পরে যা ছিল দ্বিতীয় ধাপের ৫ ডিগ্রি তাপামাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ। ফলস্বরূপ পারমিয়ান সাগর আরও উষ্ণ হয়ে উঠে। উষ্ণ সাগর আরও মিথেন হাইড্রেট এর গলন তরান্বিত করে এবং আগের প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলে তা ছড়িয়ে পরে। এবং শুরু হয় এক্সটিংশনের তৃতীয় এবং সর্বশেষ ধাপ। যা স্থলের ৭০ ভাগ প্রজাতির অবলুপ্তি ঘটায়।

কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞের সময়কাল নিয়ে আছে মতভেদ। কারও মতে পারমিয়ান মাস এক্সটিংশনের সময়কাল ছিল ২শত হাজার বছর। এবং কারও মতে ধ্বংসযজ্ঞ ছিল আরও দ্রুত ৪৮ থেকে ৬০ হাজার বছর। পারমিয়ান মাস এক্সটিংশন এর পর শুরু হয় বিখ্যাত ‘মেসজইক এরা’ বা ডাইনোসর যুগ। যার সলিল সমাধি ঘটে সর্বশেষ মাস এক্সটিংশন ক্রাটেসিআসে। শুরু হয় স্তন্যপায়ীদের রাজত্ব।

লেখকঃ গবেষণা সহকারী
ল্যাবোরাটরি ফর সার্ফেস সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি
ইউনিভার্সিটি অব মেইন, যুক্তরাষ্ট্র

Check Also

মস্তিস্ক ভক্ষক অ্যামিবা !

এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে অনেক ঔষধ  Naegleria fowleri  (নেগেইলারিয়া ফাউলিরি) এর বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে, তাদের কার্যকারিতা অস্পষ্ট; কারণ প্রায় সব সংক্রমণই মরণঘাতি।

অসাধু ব্যবসায়ীক চক্রেই ভেজাল ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা সাধারণ

পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট এর ফল পরীক্ষার তথ্যানুযায়ীই বলতে হয় যে, এ দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল এবং দেহের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর বলেই চিহ্নিত হয়েছে। সারা দেশ থেকেই স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্য দ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *