স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের নিরবতাই চিকুনগুনিয়ার ব্যপকতার জন্য দায়ী

১৯৫২ সালে প্রথম তানজানিয়ায় চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৬০টি দেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়লেও এবছরের মে মাস থেকে তার প্রকোপ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আট/নয় বছর স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিটি করপোরেশনের নিরবতার ফলশ্রুতিতেই আজকের এ পরিস্থিতির সৃষ্টি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাম্প্রতিক এক জরিপে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে আড়াইগুণেরও বেশি। অর্থাৎ ঢাকা মহানগরীতে এডিস মশার প্রকোপ অনেক বেশি এবং এ কারণে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের হারও অনেক বেশি। এমতাবস্থায় গত ০৫ জুলাই ২০১৭, বুধবার, সকাল ১১.০০টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-সহ ২০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে “চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই”-দাবীতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।

পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলন (পবা)-ও সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান-এর সভাপতিত্বে এবং পবা’র সহ-সম্পাদক এম এ ওয়াহেদের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবা’র সম্পাদক সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, পবা’র সহ-সম্পাদক মো. সেলিম, পবা’র সদস্য ক্যামেলিয়া চৌধুরী, বিসিএইচআরডি-এর নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হক, বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণকারী নেপালের দলনেতা অজিত বড়াল, নগরবাসী সংগঠনের সভাপতি হাজী শেখ আনসার আলী, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট-এর কর্মসূচী ব্যবস্থাপক সৈয়দা অনন্যা রহমান, ইয়ুথ সান-এর সভাপতি মাকিবুল হাসান বাপ্পি প্রমুখ।

পবা’র সাধারণ সম্পাদক বক্তব্যে বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশের জনগোষ্ঠির একটি বিশাল অংশ আজ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। ঢাকা মহানগরীর প্রায় প্রতিটি পরিবারে এক বা একাধিক সদস্য এ রোগের শিকার এবং জনমনে এনিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত একটি ভাইরাস। ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহনকারী এডিস মশাই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহন করে। এডিস মশা সাধারনত পানিতে জন্মায়। এ মশা মূলত ভোরে ও সন্ধ্যায় মানুষকে কামড়ায়। সাধারনত মশা চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ানোর পর যদি সুস্থ মানুষকে কামড়ায়, তখন এ রোগ সংক্রমিত হয়। চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজেই ভোগান্তির শিকার হন তা নয়, তিনি চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারীও বটে। মশা কামড়ানোর ৪ থেকে ৮ দিনের মাথায় এ রোগ দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। তারপরও জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং জনগণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বক্তব্যে আস্থা রাখতে পারছে না। গত ০৩ জুলাই তারিখে স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেন চিকুনগুনিয়া বিষয়ে সরকার সচেতন ও সতর্ক। ইতিমধ্যে মানুষকে সচেতন করার নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জুলাই ও আগষ্ট মাসে জনসচেতনতা বাড়াতে দুটি বড় কর্মসূচির আয়োজন করা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রীর এ বক্তব্যে দেশের জনগণ হতাশ। যেখানে ঢাকা মহনগরীর প্রায় প্রতিটি পরিবারে এক বা একাধিক সদস্য চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ও রোগটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এবং ডেঙ্গুর ঝুঁকিও দ্বারপ্রান্তে তখন তিনি জনসচেতনতা বাড়াতে দুমাস সময় লাগিয়ে দিবেন। তা কোনভাবেই কাম্য নয়। চিকুনগুনিয়ার ব্যাপকতা ও ডেঙ্গুর ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রী এবং ঢাকার মেয়রদ্বয় জরুরীভিাত্ততে ক্রাশ প্রোগ্রাম নিবেন এটাই নাগরিকদের প্রত্যাশা।

অন্যান্য বক্তারা বলেন, অনুকূল পরিবেশ তথা বৃষ্টি ও আবহাওয়ার ঊষ্ণতা বেশি হওয়ায় চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার প্রকোপ বাড়ছে। চিকুনগুনিয়ার লক্ষন হলো অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর যা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইটে উঠে যায়, প্রচন্ড মাথা ব্যথা, সারা শরীরে ব্যথা বিশেষ করে মাংসপেশী, পায়ের তলা, হাঁটু, হাত ও পায়ের গিরায় গিরায়। আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁটতে এবং হাতে পানির গ্লাস পর্যন্ত উঠাতে পারে না। একেবারেই খাওয়ার রুচি থাকে না। কেউ কেউ ৪-৫ দিনের মধ্যে সেরে উঠলেও কিছু ক্ষেত্রে ৪-৬ মাস সময়ও লাগতে পারে। অনেকে চলাফেরাও করতে পারে না। রোগটি অনেকদিন ধরে রোগীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য কোন ভাইরাসে এতটা ভোগান্তি হয় না।

আমাদেও দেশে চিকুনগুনিয়া শনাক্তকরণে সক্ষম একমাত্র সংস্থা স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) গত তিন মাসে ৬৪৩ জন ব্যক্তির রক্ত ও লালার নমুনা পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ৫১৩ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। অর্থাৎ আইইডিসিআর-এ পরীক্ষিত নমুনার ৮০ শতাংশ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। আইইডিসিআর-এর পরীক্ষার ফলাফলই ঢাকা মহানগরীতে চিকুনগুনিয়ার ব্যাপকতা প্রমান করে।
বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে ডেঙ্গুর ঝুঁকিও বাড়তে থাকে। চিকুনগুনিয়ার পাশাপশি ডেঙ্গুর ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে। এখন জ্বর হলেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা করিয়ে নেয়া নিরাপদ। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে এখনই সচেষ্ট হতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, এডিসসহ সব ধরনের মশার বংশ বিস্তার রোধ করতে হবে।

নাগরিকের করণীয় – ঘরের বারান্দা, আঙ্গিনা বা ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে পানি পাঁচ দিনের বেশি জমে না থাকে। এসি বা ফ্রিজের নিচেও যেন পানি না থাকে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। বারান্দা ও ঘরের টব, ছাদের বাগানের পাত্র, পুরানো টায়ার, যেকোন পরিত্যক্ত পাত্রে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাথতে হবে। মশাটি দিনের বেলা কামড়ায়, তাই দিনের বেলা ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা যেন ডিম পাড়ার সুযোগ না পায় তা খেয়াল রাখতে হবে।

সিটি করপোরেশনের করণীয় – বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি রাস্তা ও ফুটপাত এবং ডাষ্টবিনে পড়ে থাকা ডাবের খোসা ও বিভিন্ন ধরনের পাত্রে জমা পানিতে এ মশা বংশবিস্তার করে। এছাড়া রাস্তা ও ফুটপাতে জমা পানিতেও এ মশা বংশবিস্তার করে। রাস্তা, ফুটপাত ও ডাষ্টবিনে পড়ে থাকা আবর্জনা নিয়মিতভাবে পরিস্কার করতে হবে এবং ফুটপাত ও রাস্তায় যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এডিসসহ সব ধরনের মশার বংশ বিস্তার রোধ করতে হবে।
চিকুনগুনিয়া প্রায় সত্তর বছরের পুরাতন হলেও এর কোন প্রতিশোধক আবিস্কৃত হয়নি। এ রোগে মনগড়া কোন ঔষধ না খেয়ে বরং বিশ্রাম নেয়া এবং প্রচুর তরল জাতীয় খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করা অধিকতর শ্রেয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফলে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিনিয়তই বাড়তে থাকবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবী তুলে ধরা ছাড়া বেশি কিছু করার নেই। কিন্তু নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে দেশীয় প্রেক্ষাপটে এখনই বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা আবশ্যক। বিশেষ করে ব্যাপকহারে দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানো, ভ’পৃষ্ঠস্থ পানির ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি লক্ষ্যে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, লেক ও দিঘী-পুকুর দখল-ভরাটমুক্ত ও খনন করা, দিঘী-পুকুর সৃজন করা, ইত্যাদি। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফলে জনস্বাস্থ্যের উপর যে বিরুপ প্রভাব পড়বে তা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং বিরুপ প্রভাব মোকাবেলার পথ খুজে বের করা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারনা চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব স্থায়ী হবে। এবছর প্রধানত ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও আগামী বছরগুলোতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস এবং জনসচেনতা সৃষ্টি করা জরুরী। এলক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের জরুরীভিত্তিতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন।

মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরকে জরুরীভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় চিকুনগুনিয়ার মতো ডেঙ্গুও ব্যাপক আকার ধারন করবে। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও কমিউনিটি পর্যায়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

করণীয়
১. জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এডিসসহ সব ধরনের মশার বংশবিস্তার রোধে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরকে ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে জরুরীভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বস্তরের জনগনকে সচেতন করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
৩. মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও কমিউনিটি পর্যায়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফলে জনস্বাস্থ্যের উপর যে বিরুপ প্রভাব পড়বে তা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং বিরুপ প্রভাব মোকাবেলার পথ খুজে বের করা।

Check Also

মস্তিস্ক ভক্ষক অ্যামিবা !

এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে অনেক ঔষধ  Naegleria fowleri  (নেগেইলারিয়া ফাউলিরি) এর বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে, তাদের কার্যকারিতা অস্পষ্ট; কারণ প্রায় সব সংক্রমণই মরণঘাতি।

অসাধু ব্যবসায়ীক চক্রেই ভেজাল ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা সাধারণ

পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট এর ফল পরীক্ষার তথ্যানুযায়ীই বলতে হয় যে, এ দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল এবং দেহের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর বলেই চিহ্নিত হয়েছে। সারা দেশ থেকেই স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্য দ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *