বিশাল সমুদ্র সম্পদ রক্ষা ও ব্যবহারে উদ্যোগ গ্রহণ

downloadতাসকিনা ইয়াসমিন
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তিকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ সমুদ্র অঞ্চল পেয়েছে তা যেন আর একটি বাংলাদেশ। আর এ সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদ রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে বেশকিছু উদ্যোগ। দেশের জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু স্থলভাগ সম্পদ বাড়ছে না। তাই দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জীবনমান উন্নয়ন ও চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যেই সরকার নতুনভাবে সমুদ্রসম্পদের ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে। উপার্জনের অতিরিক্ত দিক হিসেবে সমুদ্র সম্পদের শনাক্তকরণ, আহরণ এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি পর্যায়ে কাজ হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এমনিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্র নিয়ে প্রতিবেশীদের কোনো বিরোধ ছিল না। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস  প্রাপ্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ দুটির সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে কিছু বিপত্তি দেখা দেয়। ফলে সমুদ্রে বাংলাদেশের তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পদ আহরণ কার্যক্রম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। আর এ সময়ই বাংলাদেশ সমুদ্রে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনবিষয়ক ট্রাইব্যুনাল (ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দি সি) ইটলস বাংলাদেশ-মিয়ানমারের বিরোধের রায় দেয়। এতে বাংলাদেশ পায় ১,১১,৬৩১ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ ২০ কিলোমিটার সমুদ্র্রে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব, ৩৭০ কিলোমিটার একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) এবং ৩৭০ কিলোমিটারের বাইরে মহীসোপানে সব প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার পেয়েছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন আছে। এ ব্যাপারে আগামী বছরের মাঝামাঝি রায় পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী বাংলাদেশ। এ ঘটনার পরই সমুদ্রের ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহী হয়েছে সরকার। সরকার এখন সমুদ্র সম্পদ সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়ন করতে চাইছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম বিভাগের সচিব রিয়ার এডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধের রায়ে বাংলাদেশ ১,১১,৬৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকা পেয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমার পেয়েছে, ১,৭১,৮৩২ বর্গকিলোমিটার। এর মাধ্যমে মিয়ানমার ঘোষিত ১৭টি ব্লকের মধ্যে বাংলাদেশ অধিকার হারিয়েছে ৫টি ব্লকের আর মিয়ানমারের অধীন বাংলাদেশের ৮টি ব্লক ছিল যার ৫০ ভাগই বাংলাদেশ পেয়েছে। তাই এখন সমুদ্র সম্পর্কে পুরনো ধ্যান-ধারণা বদলে ফেলে সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার করা প্রয়োজন। আর এটি হলে শুধু বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে তা নয়, বরঞ্চ এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও বাংলাদেশ সক্ষম হবে।
বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, শুধু চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে বছরে আসে ২৫০০ বাণিজ্যিক জাহাজ। এ জাহাজের আনাগোনায় মিলে ৪৯.৫ বিলিয়ন ডলার। যা মোট বার্ষিক বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ। মোট  বৈদেশিক বাণিজ্য হয় ৫৫ বিলিয়ন ডলারের।
বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে ৬৯টি জাহাজ। এর ফলে কমেছে বিদেশি জাহাজ ভাড়া খরচের পরিমাণ যা এক সময় ছিল বছরে ৬ বিলিয়ন ডলার। জাহাজশিল্প ঘিরে শিপিং এজেন্সি, স্টিভাডরিং, শিপ-চাডলার, ফ্রেইড-ফরোয়ার্ডিং, ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যা সমুদ্র পরিবহন ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলছে। জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশ ১৩তম এবং জাহাজ ভাঙায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। সমুদ্রে টহলের জন্য একটি যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। সমুদ্র থেকে পাওয়া গ্যাস বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় ব্যবহৃত হচ্ছে। মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর নতুন ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্যে কাজ করছে। বঙ্গোপসাগরে রয়েছে বিশাল মৎস্য সম্পদ। আর এ মৎস্যসম্পদ ঘিরে উপকূলের ৩০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে।
সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে লবণ উৎপাদন শিল্প। সমুদ্রের লোনা পানিকে আটকে সূর্যের তাপ ব্যবহার করে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ টনেরও বেশি লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। যা দেশের চাহিদা পূরণ করছে। সমুদ্রে গ্যাস হাইড্রেট (যা থেকে মিথেন গ্যাস উৎপাদন সম্ভব), পলিমেটালিক ম্যাঙ্গোনিজ নডিউলস এ থেকে কপার, ম্যাগনেশিয়াম, নিকেল, কোবাল্টসহ মূল্যবান ধাতু রয়েছে, এগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য পরীক্ষামূলক উত্তোলন করা হচ্ছে। এছাড়া পলিমেটালিক সালফাইড এবং কোবাল্ট সমৃদ্ধ ফেরোম্যাঙ্গানিজ ক্রাস্ট দেশের ইইজেড বা মহীসোপানে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। এছাড়া জিরকন, ইলেমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, রিউটাইল সমুদ্রে আছে। বাংলাদেশেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত  কক্সবাজার। এটি ছাড়াও সেন্টমার্টিন্স এবং কুয়াকাটার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে বছরে এখানে আসছে বিদেশি পর্যটক।
সমুদ্রকে ঘিরে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ : সূত্র জানায়, মিয়ানমারের সঙ্গে রায়ে জেতার পর থেকেই সরকার সমুদ্র বিষয়ে বেশ উদ্যোগী হয়েছে। এ লক্ষ্যে তারা বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সমুদ্র পথে আসা কন্টেইনার নদীপথে দ্রুত আনা-নেয়ার লক্ষ্যে ঢাকার কাছে পানগাঁওয়ে কন্টেইনার টার্মিনাল চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এটি চালু হলে কন্টেইনার পরিবহন খরচ কমবে ৩০ শতাংশ। সমুদ্র পরিবহনের ভবিষ্যৎ চাহিদা মাথায় রেখে চট্টগ্রামের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার জাতিসংঘ সমুদ্র আইনের কনভেনশনে অন্তর্ভুক্ত ‘হাইলি মাইগ্রেটরি ফিশ স্টকস অ্যান্ড স্ট্রাডলিং ফিশ স্টকস এগ্রিমেন্ট’ অনুমোদন দিয়েছে। এ কারণে ২০০ নটিক্যাল মাইলের ভেতরে ও বাইরে গভীর সমুদ্রে বড় ট্রলার দিয়ে মাছ ধরার সুযোগ পাবে।

সুত্রঃ দৈনিক মানবকণ্ঠ ২২/০৪/২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading