বৈশ্বিক ইস্যু এখন পানি

আতিকুর রহমান

downloadজাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৯৩ সাল থেকে স্বাদু পানির ওপর একেকটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক পানি দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবারের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘Water, water every where, only if we share.’ যার মূল কথা হলো— একমাত্র সহযোগিতাই পারে বিপুল চাহিদার বিপরীতে পানির জোগান নিশ্চিত করতে; যা কিনা বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। জীবন রক্ষা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পানির ভূমিকা কী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি শস্য উত্পাদনে, স্বাস্থ্যরক্ষায়, অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সহায়ক এবং পরিবেশ ও প্রাচুর্য রক্ষা করে। জলজ কিংবা উভচর প্রাণী বোঝে— পানিতে যদি সে ডিম ছাড়তে না পারে, তাহলে আর নতুন প্রাণের জন্ম হবে না। উড়ে বেড়ানো পোকা বা মাছি জানে, বিশুদ্ধ পানি ডিম ছাড়ার জন্য কতটা প্রয়োজনীয়। শিল্পোন্নত দেশগুলো বোধ হয় এর গুরুত্ব বুঝতে পারে না।
এশিয়াবিষয়ক ভাষ্যকার অ্যান্ডি মুখার্জি বলেছেন, এশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতিতে যে বস্তুটি সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে— তা তেল নয়, পানি। ১৯৯৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের তত্কালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল মেরাগেলডিন বলেছিলেন, ‘এ শতাব্দীতে যুদ্ধ হয়েছে তেল নিয়ে, আগামী শতাব্দীতে লড়াই হবে পানি নিয়ে।’ ২০০৮ সালে ইউএস ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল গ্লোবাল ট্রেন্ড-২০২৫-এর প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাদেশের পানিসংকটকে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় যেভাবে পানি দুর্মূল্য হয়ে উঠছে, তাতে দেশগুলোর মধ্যে পানির উত্স নিয়ে সহযোগিতা কঠিন হয়ে পড়বে।
সে সময় কথাটির তাত্পর্য অনুধাবন করা সম্ভব না হলেও নতুন শতাব্দীর শুরুতে পানি নিয়ে বেশকিছু বিয়োগান্তক ঘটনা বাণীগুলোকে সত্যতায় রূপ দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে পানি সমস্যা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, এজন্য এখন আর এক-দুটি দেশ নয়, এশিয়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে শুরু করে সাউথ এশিয়া, মিডল ইস্ট, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা আজ পানি সমস্যার মুখোমুখি। এ সংকটের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, ল্যাঙ্কো, জয়প্রকাশ, রিলায়েন্স, জিএমআর,   টাটা, গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ বিশ্বের প্রভাবশালী আর্থিক সংস্থাগুলো।
তাদের দেয়া শর্তসাপেক্ষে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে কোনো কোনো দেশে প্রাকৃতিক উত্স থেকে প্রাপ্ত পানিও জনগণকে কিনে খেতে হচ্ছে। এদিকে পানির জন্য একেকটি দেশ নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে অন্য দেশকে ঠেকিয়ে রাখছে। পানির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে অনেক দেশ হাজার হাজার সেনা দিয়ে পাহারা দিচ্ছে বিরোধপূর্ণ নদী। আবার অপেক্ষাকৃত কম শক্তির প্রতিবেশী দেশকে অভিন্ন নদীর পানি থেকে সুকৌশলে বঞ্চিত করছে অনেক দেশ। অভিন্ন এ নদ-নদীগুলোর নিজ ভূখণ্ডে অবস্থিত অংশে তারা বাঁধ তৈরি করে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দিচ্ছে।
পানি ব্যবসার পাশাপাশি অরো এক ধরনের বাণিজ্য এখানে উম্মোচিত, তা হচ্ছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। তথ্যসূত্রে জানা যায়, এশিয়ার চারটি দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ৫৫২টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তানে ছয়টির নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে, আরো সাতটি নির্মাণাধীন। পরিকল্পনাধীন আছে ৩৫টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ভুটানে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে পাঁচটির, পরিকল্পনাধীন আরো ১৬টি। নেপালে ১৫টির কাজ শেষ হয়েছে। নির্মাণাধীন ও পরিকল্পনাধীন রয়েছে যথাক্রমে ২টি এবং ৩৭টি। কিন্তু এদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে ভারতের বাঁধ কর্মসূচি। ভারত এর মধ্যে ৭৪টি বাঁধের নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলেছে। ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, এ ৫৫২টি বাঁধ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীর উজানে। এখান থেকে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশ না পেলেও ক্ষতির শিকার হবে ব্যাপকভাবে।
বিশ্বের অনেক বড় নদীই একাধিক দেশের অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ১৯৬৬ সালে হেলসিংকিতে গৃহীত হয়েছে আন্তর্জাতিক আইন বা নীতিমালা। নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ অভিন্ন নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন অবশ্যই বিবেচনা করবে। একই কথা বলা হয়েছে ১৯৯৭-এ গৃহীত জাতিসংঘের নদী কনভেনশনের (UN Convention on the Law of Nevigational Uses of International Water Courses) ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রবাহিত নদীগুলোর উজানে ভারত সরকার নিজস্ব বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব নীতিমালা মানছে না।
প্রত্যেক দেশ তাদের ভৌগোলিক অবস্থান, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং নিজ স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে পানি আইনগুলো তৈরি করে। এ কারণে অভিন্ন নদ-নদী এবং পানির উত্সগুলোর পানিব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সমঝোতা অনেক ক্ষেত্রেই বাধার সম্মুখীন হয়। বর্তমানে যেসব আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে, সেগুলো আন্তঃসীমান্ত পানি বিরোধ মেটাতে পারছে না। কেননা প্রত্যেক দেশই নিজ স্বার্থ রক্ষায় এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, এ কাজ করতে গিয়ে অন্যের অধিকার খর্ব করলেও সে ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা থাকে না। তাই এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন থাকা জরুরি।
পানি যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো দেশের ভৌগোলিক অঞ্চলের একক সম্পদ নয়, তাই এর    ব্যবহারের অধিকার গতিপথের আশপাশে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে। দিন দিন বিশ্বে বিশুদ্ধ স্বাদু পানির জোগান কমছে।   চাহিদা আর জোগানের এই চিরায়ত দ্বৈরথ আগামী দিনগুলোয় কতটা প্রকট হবে সেটাই এখন প্রশ্ন। আর এ দ্বৈরথকে সীমার মধ্যে রাখতে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কতটা     সচেষ্ট হন, তাও দেখার বিষয়।
লেখকনিবন্ধকার
onatiq88@yahoo.com
সূত্রঃ বণিক বার্তা ১৭/০৫/২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading