জীববৈচিত্র্য ; আশাজাগানিয়া বনমোরগ

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

মাঝারি আকারের ভূচর পাখি ‘লাল বনমুরগি’ নামটা শুনলে সহজেই অনুমান করা যায় এরা পাহাড়ি বনাঞ্চলের চিরস্থায়ী বসিন্দা। নিবিড় বনের গহিনে এদের জন্ম। উঁচু-নিচু টিলা আর ঝোপ-ঝাড়েই এদের বেড়ে ওঠা। বনভূমির তৃণময় অমসৃণ পথ বেয়ে এদের দৌঁড়ঝাপ আর কখনোবা শব্দময় উড়াউড়ির প্রস্তুতি। জনহীন বনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত। গত মে মাসে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিটিআরআই) এর চা বাগান এলাকায় এদের ছয় সদস্যের একটি পরিবারকে দেখেছিলাম। শেষ বিকেলের মৃদু আলোয় তিনটি ছানাকে সাথে নিয়ে একটি লাল বনমোরগ ও দু’টি বনমুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষের ভয় তাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায় বলে হয়তো একবার দেখা দিয়েই নিমিষে পালিয়ে গেল। পিছু নিয়েও আর পাওয়া গেল না। বনমুরগি শরীরে রয়েছে বাহারি রঙের বর্ণছটা। লাল, কমলা, সোনালি হলুদ, কালচে বাদামি, নীলাভ কালো প্রভৃতি নানা রঙের বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। বিশেষত বনমোরগটি দেখতে অধিকতর সুন্দর। এরাই আমাদের গৃহপালিত সকল মোরগ-মুরগির পূর্বপুরুষ। এক সময় এরা সারা বাংলাদেশে বি¯তৃত ছিল। মানুষের বৈরী আচরণ ও নানা ধরণের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কারণের জন্য এদের সংখ্যাও এখন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। লাল বনমুরগি’র ইংরেজি নাম Red Junglefowl আর বৈজ্ঞানিক নাম Gallus gallus।
সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিং’ এর উপর সফল গবেষণা সম্পন্ন করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় এ গবেষণা কাজে অংশ নিয়েছেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, প্রভাষক শায়ের মাহমুদ ইবনে আলম,এবং বন্যপ্রাণী গবেষক মোঃ শফিকুল ইসলাম ও আবু ইউসুফ আল আসকার। নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এলো বনমোরগের কৃত্রিম প্রজনন সফলতা। Bonmorog_Photo by Monirul H Khan
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠের এ প্রতিবেদককে বলেন, বনমুরগি উপর ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিং’ এবং ‘রি-ইন্ট্রোডাকশন’ এর এ সফলতা আমাদের এক অনন্য অর্জন। দু’ বছরের গবেষণায় এই সফলতা আমরা পেয়েছি। প্রথমে রাঙ্গামাটির বরকল থেকে Gallus gallus murghi প্রজাতির কিছু লাল বনমোরগ-মুরগি ধরে গবেষণাগারে আমরা নিয়ে এনেছিলাম ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের জন্য। বনমুরগি’র ডিমগুলোকে ‘প্রকৃতিক পদ্ধতি’ এবং ‘কৃত্রিম পদ্ধতি’ এই দু’ভাবে ফুঁটিয়ে ছানা উৎপাদন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ছানাগুলোকে বড় করে চলতি বছরের ২২ মার্চ টাঙ্গাইলের মধুপুর জাতীয় উদ্যানে আমরা ছেড়ে দিয়েছি। বনে ছেড়ে দেয়ার উদ্দেশ্য হলোÑ তাদের ‘রি-ইন্ট্রোডাকশন’ করানো। অর্থাৎ তাদেরকে কৃত্রিমভাবে উৎপন্ন করে বনে ছেড়ে দিলে এরা ঠিকভাবে ‘সারভাইভ’ করে কি না? বা ‘সারভাইভ’ করতে গেলে কি কি ধরণের সমস্যা হয়? ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের সমস্যা কি কি এগুলোর উপর নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়াই ছিল আমাদের গবেষণার বিষয়।’
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় আমরা দেখেছি বনমোরগ মহামারী বার্ড-ফ্লু রোগে কখনোই আক্রান্ত হয় না। সুতরাং এদের যদি ‘রি-প্রোডাকশন’ করা যায় তাহলে পরিবেশ, পল্ট্রিশিল্প ও ব্যবসাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করা সম্ভব। প্রতি বছর শীত মৌসুমে যে বিশাল পরিমাণ মোরগ-মুরগি বার্ড-ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তা থেকেও রক্ষা পাবে বাংলাদেশ। যেহেতু দ্রুত বনের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে বনমোরগ কমে যাচ্ছে; এদের সমস্যাটা দূর করার জন্য আমরা ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের’ মাধ্যমেই এদের উৎপাদন করে ‘রি-ইন্ট্রোডাকশন’ এর জন্য বনে ছেড়ে দিয়েছি। বাংলাদেশ ছাড়াও ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের উপর ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং সুইডেনে গবেষণা হয়েছে।’গবেষকদের একজন মো.শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এ গবেষণার মাধ্যমে দেখতে চেয়েছি কৃত্রিম উপায়ে বন মোরগ-মুরগি উৎপন্ন করে দেশে খাদ্যচাহিদা পূরণ ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব কি না এ ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত গবেষণাপত্র প্রকাশ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘বনমোরগের সংখ্যা আগের মতো ব্যাপক না থাকলেও মোটামুটি পর্যায়ে রয়েছে। শ্রীমঙ্গলে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং চা বাগান এলাকা থাকায় এ দুই পরিবেশেই এরা ভালভাবেই বেঁচে থাকতে পারে। বন্যপ্রাণি শিকারের উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ থাকায় এরও সুফল পাচ্ছে তারা।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সকল গৃহপালিত মোরগ-মুরগি যদি বার্ড-ফ্লু বা নতুন কোনো সংক্রামক রোগে মরেও যায় তবে আমরা ওই বনমোরগ-মুরগিকে ধরে আবার গৃহপালিত করে ফেলতে পারবো। যেমন ধরা যেতে পারেÑ গৃহপালিত গরু কথা। আফ্রিকাতে গরুর যে ‘ওয়াইল্ড-ভ্যারাইটি’ ছিল তা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন যদি খুব মারাত্মক রোগে সব গরু মরে যায় তবে আমরা আর কোথাও গরু খুঁজে পাবো না। এই বনমোরগ-মুরগি বুনো অবস্থায় রয়েছে বলেই সেটা অনেকটা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার মতো।’

বন্যপ্রাণী সূত্রে জানা গেছে, লাল বনমোরগ দৈর্ঘ্যে ৬৫ থেকে ৭০ সেমি এবং বনমুরগি ৪০ থেকে ৪৫ সেমি হয়ে থাকে এবং চেয়ারা ও আকার দুটোই ভিন্ন হয়। ওজন প্রায় এক থেকে দেড় কেজি। বনাঞ্চলের নির্জন স্থানে জোড়া অথবা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বিচরণ করে থাকে। এরা পায়ের তীক্ষ্ম নখ দিয়ে মাটি আঁচরে খাবার খোঁজতে থাকে। শস্যদানা, বীজ, নরম কচিঘাস, পোকামাকড়, কেঁচো প্রভৃতি বৈচিত্র্যমত খাবারে অভ্যস্ত এরা। ফেব্র“য়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এদের প্রজনন মৌসুম। বনমুরগি ঘন ঝোপ-ঝারের মধ্যে মাটি খুঁড়ে গর্ত করে লতাপাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে ৫টা-৬টা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো ফিকে পীতাভ ও লালচে বাদামি রঙের। প্রায় একুশ দিন পর ছানা ফুটে। ছানাগুলো মায়ের সাথে মাকে অনুসরণ করে খাবার সন্ধানে এদিক-ওদিন ঘুরাফেরা করতে থাকে।

লেখক : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং
দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

সূত্র : ২২ জুন ২০১৩ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading