"ড. এস.এম. ইমামুল হক" একজন নিবেদিতপ্রাণ মৃত্তিকা বিজ্ঞানীর সাথে কিছুক্ষণ

অধ্যাপক ড. এস.এম. ইমামুল হক, শুধু বাংলাদেশ নয় বরং উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত মৃত্তিকা বিজ্ঞানী এবং শিক্ষানুরাগী। মৃত্তিকা বিজ্ঞানে তাঁর অবদান অতুলনীয়। মাটি থেকে পানির মাধ্যমে খাদ্য চক্রে আর্সেনিকের সংক্রমণ এবং প্রকোপ নিয়ে তাঁর গবেষণা দেশে বিদেশে প্রশংসিত।বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া সেন্টার ফর এনভাইরনমেন্টাল রিসার্চ এর প্রতিষ্ঠাতা ড. ইমামুল হকের রয়েছে ২২০ টিরও বেশী গবেষণাপত্র।এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে যুক্ত আছেন নিজ বিভাগের শিক্ষকতায়। জীবনের নানা পর্যায়ে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি সরূপ তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশ একাডেমী অব সাইন্স গোল্ড মেডেল, পেয়েছেন ইউজিসি এ্যাওয়ার্ড, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পদক,বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক, ছাড়াও অসংখ্য সম্মাননা।এই মনীষী শত ব্যস্ততার মাঝেও কিছুক্ষণের জন্য মুখোমুখি হয়েছিলেন এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমের। তাঁর সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন রাজিন আশরাফ। 

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ কেমন আছেন স্যার?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ ভালো আছি ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, পরিবেশ বিজ্ঞানের আবির্ভাব কোথা থেকে হলো ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  জীবসত্তা এবং পরিবেশ একে অপরের সাথে পরিপূরক । সৃষ্টির আদি থেকে এই নিবিড় সম্পর্ক চলে আসছে । কিন্তু সাম্প্রতিককালে জীবসত্তা তথা মানুষের কিছু অবৃমিষ্যকারী কার্যকলাপের ফলে পরিবেশের সাধারণ আচরণে বিঘ্ন ঘটতে দেখা যায় । ফলে একদল চিন্তাশীল লোক পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এবং এর সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার জন্য এই বিষয়টির আবির্ভাব ঘটান, যা পরবর্তীতে পরিবেশ বিজ্ঞান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়টি চালু হয় কবে থেকে ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  ১৯৪৮ সালে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের জন্ম হয় । মূলত তখন থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানের জন্ম বলা চলে । কারন, পরিবেশের মূল উপাদান হল মাটি । পরবর্তীতে ২০০০ সালে, আমি এই বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর বিভাগের নাম পরিবর্তন করে মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ রাখা হয় এবং তখন থেকে ঢাবিতে এই বিষয়ের আবির্ভাব ঘটে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ আর কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে পাঠদান করা হয় ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে পাঠদান করা হয় । বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,,শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিষয়ক বিভাগ রয়েছে । এছাড়া এখন অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়টি রয়েছে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ শিক্ষার্থীরা কেন এই বিষয়ে পড়তে আসবে ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃতিকে ভালবেসে এবং পরিবেশের জন্য কিছু অবদান রাখতে এই বিষয়ে আসা উচিত । কারণ, এই বিষয়ের পরিধি অনেক এবং এই বিষয়ের সাথে অনেক বিষয় জড়িত । এটি একটি ইন্টার ডিসিপ্লিনারি সাবজেক্ট।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ এই বিষয় কতটা যুগোপযোগী ?imam sir

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  এই বিষয়টি খুবই যুগোপযোগী বিষয় এবং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এর চাহিদা বাড়ছে । আমাদের পরিবেশ বর্তমান যুগে যেরূপ হুমকির সম্মুখীন সেজন্য এই বিষয়টিতে পড়ালেখা করা খুবই যুগোপযোগী ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ আমাদের দেশে এর প্রেক্ষাপট কেমন ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  আমাদের দেশের মানুষ পরিবেশ নিয়ে তেমন সচেতন নয় । সেজন্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই বিষয় এখনো বেশি দূর এগোতে পারেনি । এক্ষেত্রে আমার মনে হয় সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে । তবে বর্তমানে এই বিষয়টি আর পিছিয়ে নেই । দেশে এর প্রেক্ষাপট আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ দেশের বাইরে এই বিষয়ের প্রেক্ষাপট কেমন ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  বাইরের দেশের মানুষ পরিবেশ নিয়ে বেশ সচেতন । সেজন্য তাদের চোখে এনভাইরনমেন্টাল সাইন্স এর গুরত্ব অন্যরকম। বাইরের দেশে এর প্র্যাকটিস অনেক । এই কারণে সামনে বড় বড় পরিবেশগত হুমকি থাকলেও তারা নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ এই বিষয়ের চাকুরীর বাজার কেমন ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  এই ব্যাপারে আমার উত্তরটা হয়তো একটু কঠোর হবে । আমাদের দেশে জব রেসপ্যাক্ট এর যথেষ্ট অভাব রয়েছে । তবে এটা সত্যি যে আমাদের দেশে এই বিষয়ের ক্ষেত্র কম বেশি রয়েছে এবং এর প্রসার বাড়ছে । তবে বাইরের চাকুরীর বাজারে এই বিষয়ের এর চাহিদা অন্যরকম । সেখানে অনেক ভালো ভালো কাজের সুযোগ রয়েছে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ এই বিষয়ে পড়ালেখা করে একজন শিক্ষার্থী কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  ভাবতে অবাক হলেও সত্যি পরিবেশ বিজ্ঞানে পড়ে একজন শিক্ষার্থী যে কোন সেক্টরে এ কাজ করতে পারে । যেমন কেউ পদার্থ নিয়ে পড়তে চাইলে পরিবেশ বিষয়ক পদার্থবিজ্ঞান,, রসায়নে যেতে চাইলে পরিবেশ বিষয়ক রসায়ন,, কেউ যদি অর্থনীতিতে পড়তে চায় সেক্ষেত্রে পরিবেশ অর্থনীতিতে পড়তে পারে । এমন কি কেউ যদি বাংলায় পড়তে চায় এই বিষয়টি তাকে প্রকৃতি সম্পর্কে আরও গভীরভাবে বুঝতে শেখাবে এবং প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে তৈরি করবে । সুতরাং এই বিষয়ে পড়লে সবদিকের পথ খোলা থাকে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই বিষয়টি কিভাবে মানুষকে সচেতন করতে পারে ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  এই বিষয়ে জোর না দেয়ার কোন সুযোগ নেই । আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সকল কোর্স এর সাথে পরিবেশ বিষয়ক একটি কোর্স বাধ্যতামূলক করে দেয়া উচিত । এছাড়া স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করতে পরিবেশ বিষয়ক তথ্যভাণ্ডার পড়ানো উচিত । যার ফলে তারা উচ্চ শিক্ষায় এই বিষয়ে না পড়লেও প্রকৃতির প্রতি যাতে তাদের ভালবাসা জন্মায় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, আমাদের সামনে অনেক পরিবেশগত হুমকি এই ব্যাপারে আমরা কি করতে পারি ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  ২০০৮ সালে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে একটি কনফারেন্সে যোগদান করি, সেখানে আমি কিছু বক্তব্য রাখি । আমাদের পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এসব হবেই । আমরা যতটা উদ্বেগ প্রকাশ করছি হুমকি ততোটা সামনে নয় । তবে অবশ্যই সুদূর ভবিষ্যতে এসব অনেক বড় ভূমিকা রাখবে । কিন্তু এসব থেকে আমরা কিভাবে বেরিয়ে আসবো সে পথ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে । সুতরাং আমি এটাই বলব, পরিবেশগত সমস্যা থাকবে এই ব্যাপারে চিন্তিত না হয়ে বরং উচিত আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে গভীরভাবে জানা এবং এর সমাধান বের করা । তবে আশার  ব্যাপার হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমাদের দেশ পরিবেশগত দিক দিয়ে যথেষ্ট ভালো অবস্থানে আছে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ একজন শিক্ষার্থী পরিবেশ বিজ্ঞানে না পড়ে কিভাবে পরিবেশের জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরিবেশ নিয়ে সচেতন হওয়া উচিত । এজন্য তাদের পরিবেশ সচেতন করা আমাদের দায়িত্ব । এক্ষেত্রে আমাদের স্কুল কলেজ পর্যায়ে পরিবেশ সম্পর্কে আরো বিস্তারিতভাবে জানাতে হবে এবং এর ফলে একজন শিক্ষার্থী যেই বিষয়ে এ পড়ুক সে পরিবেশ সচেতন হবে এবং একজন প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারবে ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ  স্যার, আমাদের দেশে যেই ব্যাপারটা দেখা যায় যে, আমরা উন্নয়নের দিকে বেশি আগ্রহী কিন্তু পরিবেশের কথা বিবেচনা করি না , এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  এ ব্যাপারে আমাদের দেখতে হবে আমরা কি চাই এবং কি দরকার । আমাদের দেশে অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের দিকে বেশি খেয়াল রাখা উচিত । তবে অবশ্যই পরিবেশগত ক্ষতি না করে । আমাদের উচিত দুইটি দিকে সমানভাবে খেয়াল রাখা ।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, সম্প্রতি আপনার একটি নতুন বই “The Soils of Bangladesh” বের হয়েছে । এ নিয়ে যদি আমাদের কিছু বলতেন ?

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  ২০০৯ সালে আমি World Congress of Soil Science এর কনফারেন্সে যোগদান করি । যেখানে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে তারা অনুরোধ জানায় বাংলাদেশের মৃত্তিকা নিয়ে একটি বই লিখতে । দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রমে আমি এবং আমার সহকারী লেখক জালাল উদ্দিন বইটি লিখতে সক্ষম হই । ১৪ অধ্যায়ের এই বইটি বাংলাদেশের মৃত্তিকা সম্পর্কে জানতে সকল অবস্থানের মানুষকে সহায়তা করবে ।

স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য ।

ড. এস.এম. ইমামুল হকঃ  তোমাকেও ধন্যবাদ ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading