কোথায় বন্যপ্রাণী – অপরাধ – অপরাধী – নিয়ন্ত্রক

গাজী আসমাত গাজী আসমত

কয়েক শতাব্দী আগের কথা। তখন এ ভূখন্ড ছিল ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নামে একটি ব্রিটিশ কোম্পানীর দখলে। এ কোম্পানী কায়দা করে নবাব সিরাজকে পরাজিত, বন্দি ও হত্যা করার পর থেকে কয়েক শতাব্দী এ ভূখন্ডকে নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করেছে। কোম্পানী-নিযুক্ত বড় সাহেবদের সরল ভাষায় এদেশে লাট সাহেব বলে সম্বোধন করা হতো। তো লাট সাহেবরা নিজে সরাসরি আমাদের শোষণ-শাসন করেনি, করেছে আমলা ও জমিদার নামের কিছু তল্পিবাহকদের মাধ্যমে। শীতকালের দিনগুলোতে লাটসাহেবদের অধঃস্তন ছোট লাটেরা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন অংশে হাজার হাজার শীতের পাখি শিকারে কতোইনা মৌজ করেছেন সে কথা কিতাবে সবিস্তারে লেখা আছে। যা হোক, ১৯৪৭ সালের পরে লাট সাহেবদের স্ফূর্তি বন্ধ হয়ে গেলেও তল্পিবাহক আমলারা কিন্তু চলে যায়নি। স্ফূর্তির ধারা বোধ হয় তাদের রক্তে মিশে গিয়েছিল। পেশার টানে নেশা জাগলে দমনের অন্যতম উপায় ছিল শিকারে যাওয়া। আহ্ কী সুখ শিকারে। শিকারের লহু দেখে, নাকি পশুপাখির মরণ দাপানি দেখতে ওদের ভালো লাগতো জানি না, গোশতেরও দারুণ স্বাদ ছিল হয়তোবা। এতকিছুর পরও এসব পেশাজনিত নেশাখোর আমলারা কিন্তু একটা বিষয় ঠিকই জানতেন ‘একদিন এসব প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাবে’, এ কারণে মৃত বাঘ-চিতাবাঘের চামড়া, হরিণের কাটা মুন্ডুসহ শিং-শরীর-চামড়া পায়ের সামনে রেখে ছবি তুলে রেখেছেন। কেউবা বাঘ হত্যা করে তার গায়ের উপর ঠ্যাং উচিয়ে দিয়ে সগর্বে ছবি তুলেছেন। দক্ষিণ-এশিয়ার মানুষ ও বন্যপ্রাণীর উপর লাটগিরি শেষে লাটসাহেবরা চলে গেলেও নব্যলাটেরা কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত পাকিস্তানে রাজত্ব করেছে। পাকিস্তান ছুঁড়ে ফেলে বাংলাদেশ উদিত হলেও একদল মানুষ বন্যপ্রাণীর জিম্মাদার সেজে ছড়ি ঘোরাতে শুরু করে। তাঁরা হয়তো ভেবেছেন ‘জ্বি-হুকুম’-এর রাজত্ব চালাবেন। মহাখালীর অফিসে বসে চিঠি পাঠিয়ে দিলেই বাঘেরা সেই চিঠি পড়ে মানুষকে আর কামড়াতে আসবে না, হয়তোবা বাঘ আর কুমির এক ঘাটে পানি খাবে, সুখ-দুঃখের গপ্পো করবে। এসব দিবাস্বাপ্লিক জিম্মাদারেরা বাংলাদেশে পাকশাসনের নজির থেকেও শিক্ষা নেয়নি। ‘জোর যার মুলুক তার’ হতে পারে, কিন্তু ‘বন্যপ্রাণী তার’ হয় না। এ কথাটি বন্যপ্রাণীর জিম্মাদার বা তাবেদাররা কেন যে বুঝতে চান না বা পারেন না তা আমরা বুঝতে চাই কিন্তু পারি না। ফলটা কী হচ্ছে? লবডংকা। হুজুরদের কোনো হুংকার এখন আর কাজে আসছে না। তার প্রমাণ (তারিখ) Daily Star-এ ডলফিন ধরা, বিক্রি ও পরিবহন সংক্রান্ত সচিত্র রির্পোটটি। “The Daily Star: Fishermen net a porpoise from the Padma River in Narayanpur area under Chapainawabganj Sadar upazila yesterday morning. They later brought the sea animal to the district town and sold it to one Bharat Kumar for Tk 3, 500. Though it is illegal to catch or kill marine mammals under the Environment Protection Law, staff of the department concerned turn a blind eye to such callous act.

dolphin- daily star                         Photo:”Daily Star”

দু-তিন মাস আগে শুনেছি মহাখালী থেকে নাকি বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট (সংক্ষপে WCCU) গঠিত হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় বন বিভাগের একেকজন উঁচু পদের কর্মচারী এসব ইউনিটের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। এ সংস্থার গাঠনিক কাঠমো, কর্মপরিধি ও ধারা, লোকবলের যোগ্যতা ও সংখ্যা ইত্যাকার বিষয় সম্বন্ধে মানুষের জেনে রাখা, ভূমিকা রাখা ও সজাগ থাকার বিষয়টি ব্যাপক প্রচারে থাকা উচিৎ ছিল। আজকাল মোবাইল ফোনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধারণ কারও কথা চমৎকার রেকর্ড করা যায়। অতএব, বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত কোনো অপরাধ সাধারণ মানুষ ঘটিয়েছে, নাকি পেশাগত অপরাধী কিংবা বন বিভাগের কোনো কর্মচারী ঘটিয়েছে এবং এ ধরনের প্রমাণাদি গ্রহণযোগ্য কিনা তা এ সংস্থার স্পষ্ট বলা উচিৎ। তা ছাড়া, আগে সংঘটিত (যেমন সুন্দরবনের বাঘের বাচ্চা পাচার) ঘটনার পুনর্তদন্ত করা হবে কিনা সে সব বিষয়ও খোলাসা করা উচিত। WCCU-তে কোনো অপরাধী বা কারও বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বা চলেছে এমন কেউ আছে কিনা কিংবা কেউ অবৈধ বন্যপ্রাণী-খামারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা আছেন এমন কোনো পরামর্শক থাকলে তাওতো জানা প্রয়োজন।

 কথায় আছে না ‘দশের লাঠি একের বোঝা’ এক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। WCCU-র দায়-দায়িত্ব কেবলই বন বিভাগ ও এর কর্মচারীদের ঘিরে, জনতার সহযোগিতা চাওয়া হয়নি। বায়ান্ন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়ে স্বৈরাচার হঠাও আন্দোলন কেউ একা করতে পারেনি। মানুষের সম্পৃক্ততা না থাকলে কেবল কয়েকজন চাকুরিজীবী একা কিছুই করতে পারবেন না। অতএব, বন্যপ্রাণীর জন্য একা জিম্মাদারী না হয়ে জনগনকে জিম্মাদারী দিয়ে নিজেরা পরে জমাদার হোন। যত বড়, যত কঠিন, যত উন্নত আইনই করা হোক না কেন তার প্রয়োগ বাদ দিয়ে শুধু ফেসবুকে ফটোসেশন করলেই চলবে না, এ কথাও মনে রাখতে হবে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা দিতে না পারলে WCCU-র মত প্রচারসর্বস্ব একটি অঙ্গসংস্থা কেন সৃষ্টি করা হয়েছে।

লেখকঃ অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading