শিক্ষার আলো সকলের কাছে পৌছে দিলে হয়ত এই পার্থক্য আর থাকবে নাঃ ড. হারুনুর রশীদ

অধ্যাপক হারুনুর রশীদ, তিন দশকের বেশী সময় ধরে যুক্ত আছেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগে। মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে ছিলেন তৎকালীন মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, প্রত্যক্ষ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আর যুদ্ধকালীন সময়ে হারিয়েছেন প্রিয় সহপাঠী বন্ধু আর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। দীর্ঘ তিন দশক শিক্ষকতায় নিয়জিত থেকে দেশের সেবা করে চলেছেন, তৈরি করছেন বহু মেধাবী মৃত্তিকা আর পরিবেশ বিজ্ঞানী। এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকমের নিয়মিত আয়োজনে গুণী শিক্ষাবিদ ড. মোঃ হারুনুর রশীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম প্রতিনিধি রাযিন আশরাফ ।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, কেমন আছেন?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ ভালো আছি

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, আপনি বর্তমানে মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগে অধ্যাপনা করছেন, এছাড়া ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রাধ্যাক্ষ্য হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার আসার মূল কারণ কী ছিল?

 ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ এটা প্রায় ৪৫ বছর আগের কথা। বাংলাদেশ যেহেতু অনেক আগে থেকেই কৃষি নির্ভর দেশ তখন এই বিভাগের নাম ছিল মৃত্তিকা বিজ্ঞান। তখন মনে হয়েছিল এ বিষয়ে পড়লে দেশের জন্য কিছু করতে পারবো বা দেশের উন্নয়নে কিছু করতে পারবো। সেই ইচ্ছা থেকেই মূলত এই বিভাগে আসা এবং সেদিক থেকে মনে হয় আমি যথেষ্ট পরিমাণ সার্থক।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, বর্তমানে বাংলাদেশে কী কী পরিবেশগত ঝুঁকি রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ বাংলাদেশ এখন নানা দিক থেকেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে যেমন, ভূমিকম্প থেকে শুরু করে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পর্যন্ত বিবিধ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সামনে ঝুঁকি রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি জনসংখ্যা। জনসংখ্যার সাথে অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা জড়িত। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অন্যান্য সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।

অধ্যাপক হারুনুর রশীদ
অধ্যাপক হারুনুর রশীদ— ছবিঃ এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম

প্রশ্নঃ এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ বরফ গলছে, এর ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। বাংলাদেশের সামনে এই ব্যাপারে কতটুকু ঝুঁকি রয়েছে?

 ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ এটি নতুন কোনো ইস্যু নয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশের এই বিষয়টির ঝুঁকি রয়েছে এবং এভাবে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়তে থাকলে ধারনা করা হচ্ছে যে, অচিরেই বাংলাদেশের এক পঞ্চমাংশ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক বিশাল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ আমাদের দেশের জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপরদিকে দেশের দক্ষিনাঞ্চলে লবনাক্ততা দেখা যাচ্ছে, এই রকম পরিস্থিতিতে আমাদের শস্য উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা যেতে পারে?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ হ্যাঁ, এইসব ব্যাপার সত্যি অনেক ভাবায়। তবে আমরা এর মধ্যেও আশার আলো দেখতে পাই, যেমন কিছুদিন আগে ইরি ধানের একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে যা আগের তুলনায় ধানের উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দিবে। এছাড়াও অনেক জাত উদ্ভাবিত হয়েছে যা লবনাক্ত জমিতে চাষ করা সম্ভব।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ অন্যান্য দেশের মানুষ পরিবেশ নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতন কিন্তু সেই তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ততটা সচেতন নয়। পরিবেশগত ব্যাপারে আমাদের এমন আচরণ হওয়ার কারন কী বলে আপনি মনে করেন?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ আমার কাছে এর প্রধান কারণ শিক্ষার অভাবকেই মনে হয়। আমাদের দেশের ঘরে ঘরে আমরা এখনো শিক্ষার আলো পৌছে দিতে পারিনি। দেশের ৫০-৬০ ভাগ হয়তোবা স্বাক্ষর করতে পারে কিন্তু তাই বলে তারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। সুতরাং শিক্ষার আলো সকলের কাছে পৌছে দিলে হয়তো এই পার্থক্য আর থাকবে না।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ কিভাবে আমরা শহর ও গ্রাম উভয় অঞ্চলের মানুষকে পরিবেশগত দিকে সচেতন করতে পারি?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ এক্ষেত্রে আমার মনে হয় সঠিক পরিকল্পনার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পরিবেশগত ব্যাপারে আমরা মানুষকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কর্মশালা, আলোচনা সভা, ক্যাম্পেইন ইত্যাদির আয়োজন করতে পারি। অন্যদিকে গ্রামের মানুষদের স্থানীয় শিক্ষক, মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে সচেতন করা যেতে পারে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বর্তমানে দক্ষ শিক্ষকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এই দিকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া উচিত।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, আমাদের দেশে সরকার কর্তৃক বা দেশী ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যেসকল প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো কতটুকু শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ এরুপ প্রকল্প আমাদের দেশে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং সততার অভাব রয়েছে। একারণে আমার মতে বাংলাদেশে প্রকল্পগুলো সেরকম সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। তবে, এইসব ব্যাপারে সরকারের আরও নজরদারী বাড়ালে হয়ত আরো ভালো ফলাফল আসবে।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, সম্প্রতি যে জলবায়ু সম্মেলন হয়ে গেল তা থেকে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ কি পেল? যদিও সাধারনত বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের ধনী রাষ্ট্রের চাপের কারনে খালি হাতে ফিরতে হয়।

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ এই সম্মেলনে আমরা পুরোপুরি হতাশ নই, আমাদের দেশের বেশ কিছু প্রাপ্তি রয়েছে। এছাড়া আরো কিছু ব্যাপারে আমরা সাড়া পেয়েছি। আলোচনা চলছে বিভিন্ন ধনী রাষ্ট্রের সাথে। আশা করি সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ বেশ ভালো কিছু অর্জন করতে পারবে।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের অবস্থা খুবই নাজুক, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যায়। এর আসল কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ এই ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের যথেষ্ট পরিমাণে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে আমি মনে করি। তারা অনেকে ভিন্ন ভিন্ন ডিগ্রি নিচ্ছে, কিন্তু সুদক্ষ ও সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠছে না। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা তীব্রতর হচ্ছে। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে আমার যেটা মনে হয় তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরো সচেতন হওয়া উচিত।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ স্যার, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবাধে ধূমপানের ব্যাপারে আপনার মতামত কী? এর নিষিদ্ধকরনে প্রতিবন্ধকতাই বা কী বলে আপনি মনে করেন?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ প্রশাসন এই ব্যাপারে অনেক কাজ করে যাচ্ছে। তবে এখানেও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে মনে করি। এর জন্য জরিমানা বিধান শক্তভাবে চালু করা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃস্যার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এবং গর্বের স্থান যেখান থেকে ৭ মার্চ এর ভাষণ দেয়া হয়  যা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ধাপ হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এর আভ্যন্তরীণ পরিবেশের এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার পিছনে আসলে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন? ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি শহীদ মিনারেরও একই বেহাল অবস্থা। এগুলোর ব্যপারে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ সত্যি কথা বলতে আমি নিজেও সেই ভাষণে উপস্থিত ছিলাম। শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাষনই নয়, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধীর মত ব্যাক্তিত্বরাও এই উদ্যানে ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে এই উদ্যানের পরিবেশ দেখে আমারও চোখে পানি চলে আসে। অন্যদিকে শহীদ মিনারের অবমুল্যায়নও আমাদের খুবই ব্যাথিত করে। এই ব্যাপারে প্রশাসনের যথেষ্ট উদাশীনতা রয়েছে। আমার মতে সরকারের পর্যাপ্ত মনিটরিং এর অভাবও রয়েছে। এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের আন্তরিক মনোভাব নিয়ে জরুরী পুনর্গঠন ও সংস্কার কাজ শুরু করা উচিত।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ ২০৩০ সালে বাংলাদেশকে পরিবেশগত শৃংখলায় কোন অবস্থানে দেখতে চান?

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ আমি ২০৩০ সালে পার্ককে পার্কের মত, উদ্যানকে উদ্যানের মত, শহীদ মিনারকে শহীদ মিনারের মত সম্মান দিচ্ছি এমন অবস্থায় দেখতে চাই। আর জাতীয় ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা এবং দেশকে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ন হিসেবে দেখতে চাই। আর যদি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কথা বলি তাহলে ধনী রাষ্ট্রের উন্নয়নের ফলে আমরা যে ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তা থেকে যাতে বেরিয়ে আসতে পারি তার স্বপ্ন দেখি।

এনভায়রনমেন্টমুভ ডটকমঃ আপনাকে ধন্যবাদ, স্যার।

ড. মোঃ হারুনুর রশীদঃ তোমাকেও ধন্যবাদ। 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading