যেমন হলো ; আমাদের বাদুড় – ভালবাসা

রাহুল দাশ তালুকদার

সিলেট থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম মাত্র সাত ঘণ্টার পথ, অথচ আট ঘণ্টা অপেক্ষা সহ পনেরো ঘণ্টার দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর ভ্রমণ শেষে এসে পৌঁছালাম চিটাগাং ভেটেরনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সাইন্স ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে।উদ্দেশ্য, বাদুড় গবেষণা ও সংরক্ষণ বিষয়ক দেশের প্রথম কর্মশালায় যোগদান করা। সঙ্গী, আমার খুব কাছের ছোট ভাই, “প্রাধিকার” এর সাধারণ সম্পাদক জয় প্রকাশ রায়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী এবং গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটির সভাপতি অনিমেষ ঘোষ অয়ন, আর দুই জ্যেষ্ঠ সদস্য হাসান আহমেদ ও অরচিশ্মান দত্ত। ২৩ জানুয়ারি ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে চট্টগ্রামের মাটিতে পা রাখলাম, সিলেটের চেয়ে শীতের প্রকোপ এ শহরে কিছুটা কম হওয়ায় দীর্ঘ যাত্রার ভোগান্তি কিছুটা হলেও গা সওয়া লাগলো।কিছুক্ষণের বিশ্রাম পেলাম, এরই মধ্যে আয়োজক প্রধান নুরুল ইসলাম ভাইয়ের তাগাদা শুরু; সকাল ন’টা বাজে সুতরাং, দৌড়তে হবে কর্মশালা অডিটোরিয়ামে।

প্রথম দিনের পাঠ; মনোযোগী সব বোদ্ধা......
প্রথম দিনের পাঠ; মনোযোগী সব বোদ্ধা……

এবারে একটু পেছন থেকে আসা যাক, গত ২২ ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যা ৭টায় “ব্যাট রিসার্চ টেকনিকস ও কনসারভেশন” শীর্ষক ৩ দিন ব্যাপী কর্মশালার উদ্বোধনী হয়ে গেলো।২৩ জানুয়ারি থেকে ৩ দিন ব্যাপী এ কর্মশালায় বাংলাদেশের ৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ সাইন্স বিভাগের ২৫ জন শিক্ষার্থী বাদুড় সংরক্ষণ ও গবেষণার উপর হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী গভ. কলেজ এবং স্বাগতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সিভাসু উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. এস. মাহফুজুল বারী। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোঃ আলমগীর হোসেন, পরিচালক (বহিরাঙ্গন কার্যক্রম) ড. বিবেক চন্দ্র সূত্রধর, অধ্যাপক ড. আমিনুর রহমান, অধ্যাপক ড. আহসানুল হক, অধ্যাপক ড. এ.কে.এম. সাইফুদ্দিন, প্রফেসর ড. মোঃ কবিরুল ইসলাম খান (ডিন, ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ) অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন পরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ) প্রফেসর ড. এ.এম.এ.এম জুনায়েদ সিদ্দিকী।

 কর্মশালায় মূল আকর্ষণ বা আলোচক ছিলেন Fauna & Flora International (Combodia) এর হেড অব একাডেমিকস ড. নেইল ফারে। ড. নেইল   দীর্ঘ বিশ বছরেরও অধিক কাল যাবত বাদুড় বিষয়ক গবেষণার সাথে যুক্ত আছেন। ভিয়েতনাম, কম্বদিয়া,মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভারত, সহ পৃথিবীর বেশ কয়েকটি অঞ্চল জুড়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।কর্মশালার শুরু থেকেই যেন তাঁর অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুললেন নেইল।প্রথম দিনের প্রথম পর্ব থেকেই তাঁর ব্রিটিশ টানের পরিষ্কার ইংরেজি ভাষায় সাবলীল উপস্থাপন যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে থাকে আমাদের সকলকে। বাদুড় নিয়ে গবেষণার বিস্তারিত পদ্ধতি তুলে ধরতে থাকেন তিনি প্রতি ঘণ্টার প্রতি পর্বে। বাদুড়ের শ্রেণিবিণ্যাসবিদ্যা, বাদুড়ের ইতিহাস, বংশবিস্তার পদ্ধতি, বাংলাদেশে বাদুড়ের বর্তমান অবস্থা, বাদুড়ের রোগসমূহ, বাদুড় ধরার কৌশল, বাদুড়ের বয়স, লিঙ্গ , বাহ্যিক গঠন, প্রজাতি সনাক্তকরণ, খাদ্যাভাস, বাদুড় গবেষণায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার ইত্যাদি। আরও কতো কি যে জানা হলো তা এই সংক্ষিপ্ত লেখায় প্রকাশ করা যাবে না। তারপরও একটু আলোকপাত না করলেই নয়।

পৃথিবীর আজব প্রাণীদের মধ্যে বাদুড় একটা। ডানা আছে আকাশে উড়তেও পারে, তবু সে পাখি নয়,স্তন্যপায়ী প্রাণী!! মুখটা শিয়ালের মতো, খরগোশের মতো বড় বড় দুটো কান, ছাতার মতো অদ্ভুত দুটি পাখা– আজব হওয়ার জন্য এগুলোই হয়তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বাদুড়ের মনে হয় তাতেও মন ভরে না। আজব হওয়ার জন্য আরো কিছু চাই! অনেকেই মনে হয় ব্যাপারটা জানেন না,বেশিরভাগ বাদুড়ের বড় বড় দুটি চোখ থাকলেও সে দিয়ে তারা দেখতে পায় না। বাদুড়কে তাই দেখার কাজটা করতে হয় কান দিয়েই। তবে, কথা আছে, বড় চোখওয়ালা ফলভোজী বাদুড়েরা কিন্তু চলাফেরা আর ফল খাবার জন্য তাঁদের বড় চোখ আর কানকেই বেশী ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু, উল্টোটা দেখা যায় পতঙ্গভুক বাদুড়দের ক্ষেত্রে, এদের চোখ ছোট আকৃতির, আর কানের গড়ন গড়- পড়তা বিশাল আকৃতির। এরা শব্দত্তোর তরঙ্গ তৈরি করে চলাফেরা ও শিকার ধরার কাজটি করে থাকে।বাদুড় পৃথিবীর একমাত্র উড্ডয়ন ক্ষমতা বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণী। পৃথিবীতে প্রায় ১২০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে।

ঝুলে থাকি নিজের ঘরে; তাঁরা কেন ঝামেলা করে!!!!
ঝুলে থাকি নিজের ঘরে; তাঁরা কেন ঝামেলা করে!!!!

বাদুড়দের প্রজাতিসংখ্যা স্তন্যপায়ী প্রাণীর মোট প্রজাতিসংখ্যার শতকরা ২৩-২৫ ভাগ । প্রায় ৭০ ভাগ বাদুড় প্রজাতি পতঙ্গভূক, বাকিরা ফল-মূল খায় । বাদুড় নিশাচর প্রাণী । দিনের বেলায় অন্ধকার স্থানে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে । পা দিয়ে গাছের ডালে আটকে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিনের বেলা ঘুমিয়ে থাকে বাদুড়। গাঢ় আধারে ইকোলোকেশন ব্যবহার করে এরা যে কোন জিনিসের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। লক্ষ্য বস্তুর দিকে তীক্ষ্ণ শব্দ ছুড়ে দিয়ে এরা সেটির অবস্থান চিহ্নিত করতে পারে। তাই অন্ধকারে চলাফেরা করতে মোটেও অসুবিধা হয় না। দিনের আলো বাদুড় সহ্য করতে পারে না। তাই এ সময়টা ওরা পুরনো ভাঙা বাড়িতে, বনের ভেতর গাছের ডালে ঝুলে থেকে বিশ্রাম নেয়। রাত হলেই ওরা চলে যায় খাবার খুঁজতে। এদের খাবার তালিকায় আছে বিভিন্ন ফলমুল (আম, লিচু, কলা ইত্যাদি) আমাদের দেশের বাদুড়গুলো রাতে জাগলেও ভ্যাম্পায়ারদের মতো ভয়ঙ্কর নয়। ভ্যাম্পায়ার বাদুড়দের কেবল মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকাতেই দেখা যায়। সেখানে এদেরকে ক্ষতিকারক প্রাণী হিসেবেই দেখা হয় কারণ ভ্যাম্পায়ার বাদুররা র‍্যাবিস (rabies) বা হাইপোকন্ড্রিয়া নামের মরণব্যাধি ছড়ায়। আমাদের দেশে “নিপাহ” নামক ক্ষতিকর ভাইরাসের পোষক হিসেবে বাদুড়কে সনাক্ত করা হলেও বাদুড়ের মাধ্যমেই এই রোগে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে কিনা তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। তবে, খেজুরের রস খাওয়ার ব্যাপারে অর্থাৎ সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রক্রিয়ায় সাবধানতা অবলম্বন করলে নিপাহ থেকে মুক্ত থাকা যেতে পারে।

ভাঙলো মিলন মেলা......
ভাঙলো মিলন মেলা……অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সাথে, ড. নেইল ফারে, FAO এর সেন্টার ফর ট্রান্স বাউন্ডারি ডিজিস এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. ম্যাট ইয়ামাগি সহ শিক্ষকবৃন্দ।

বাদুড়ের উপকারিতার বয়ান বলে শেষ করা যাবে না। বাদুড় একটি প্রাকৃতিক পরাগায়ন যন্ত্র। আম, কলা, লিচু, সহ আমাদের দেশের নানা ফলের বীজ বিস্তারণ হয়ে থাকে ফল বাদুড়ের মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, ফুলের পরাগায়নে রয়েছে এদের বিশেষ অবদান। ফুলের মধু খেয়ে বাদুড় পরাগায়নে সাহায্য করে। থাইল্যান্ড কম্বোডিয়া সহ ভিয়েতনাম ও চীনের বেশ কিছু জায়গায় বাদুড়কে এসব কারণে খুব শ্রদ্ধা আর সমীহের চোখে দেখা হয়। আর পতঙ্গভুক বাদুড় কৃষি ক্ষেত্রে অবদান রাখে শস্যভুক পতঙ্গ বিনাশ করে। প্রতিবছর কম্বোডিয়া ভিয়েত্নামে লক্ষ লক্ষ ডলারের শস্য রক্ষা পায় বাদুড়ের এই অবদানে। এছাড়া, বাদুড়ের মল এক উৎকৃষ্ট সার হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা শস্যের নাইট্রোজেন, ফসফরাস আর পটাসিয়ামের একটি বড় যোগান হিসেবে কাজ করে।

এসব শুনতে শুনতে আর বাদুড়দের সাথে সময় কাটিয়ে কখন যে তিনদিন ফুরিয়ে এলো বুঝতেই পারলাম না। শেষদিনে এসে, শুধু অনুভব করলাম অনেক দারুণ আর উত্তেজনায় ঠাসা একটা সময় চোখের নিমিষে মিলিয়ে গেলো।সাথে জন্মালো অদ্ভুত এক প্রেম, বাদুড়ের প্রতি আমাদের অজানা প্রেম। তবে, পঁচিশ জন তরুণ তো তৈরি হলো আমাদের বাদুড়ের সুরক্ষার জন্য অর্থাৎ মানব জাতির সুরক্ষার জন্য; এটাই তো কর্মশালার সবথেকে বড় পাওয়া। আর কি চাই……

লেখকঃ সভাপতি, “প্রাধিকার” সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading