'দারুচিনি দ্বীপ' : এক প্রাকৃতিক বিস্ময়!!

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে বর্তমান বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বিপুল জলরাশির মাঝে জেগে ওঠা ৮ বর্গ কিমি-র মতো ছোট্ট এক ভূখন্ড, যা বাংলাদেশের ‘কক্সবাজার’ জেলা ও ‘টেকনাফ’ উপজেলার অন্তর্গত ‘নারকেল জিঞ্জিরা’ বা স্থানীয়দের কাছে ‘দারুচিনিদ্বীপ’ বলেই পরিচিত৷ যদিও আন্তর্জাতিক ভাবে এটি ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপ’ নামেই খ্যাত৷ অপার সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছে৷ বর্তমানে এর সঙ্গে ‘ছেড়া দ্বীপ’-এর সংযুক্তিঘটে আয়তন বেড়ে প্রায় ১২ বর্গ কিমি হয়েছে এবং আকৃতি নিয়েছে ‘ডামবেল’-এর এরমতো৷ সমগ্র দ্বীপটির গড় উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৭ ফুটের মতো৷

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই দ্বীপে সাধারণ মানুষের যাতায়াত শুরু হয়৷ মূলতঃ জেলে মালো সম্প্রদায়ের নিম্নবিত্তের লোকজন মাছ ও কাঁকড়া ধরতেই ওখানে যাতায়াত শুরু করে৷ অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই জায়গাটা জাহাজের নাবিকদের নজরে পড়ে৷ এমনকী তত্কালীন ব্রিটিশ প্রশাসক ক্যাপ্টেন কক্স (যার নামে কক্সবাজার) এই দ্বীপ সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করেন৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলদস্যুদের ভয়ে প্রথম প্রথম কেউই সেখানে বসবাস করতে চায়নি৷ তবে ঊনবিংশশতকের শেষ থেকে বিশেষতঃ চট্টগ্রামের লোকজন স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে৷ চারিদিকে নীল জল, পাড়ে কোথাও ম্যানগ্রোভ বা কেয়ারজঙ্গল, কোথাও ঝাউবীথি৷ ‘সাগর লতা’ মাথায় ছোট-ছোট ফুল নিয়ে বালির উপর লতিয়ে বেড়াচ্ছে আর এরই মাঝে নারকেল গাছের ঘন সারি নীল আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে৷ ঘন নারকেল গাছের জন্যই এর নামকরণ হয়েছে ‘নারকেল জিঞ্জিরা’৷ Saint_Martin_Island

বর্তমানে বাংলাদেশ ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ-‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপ’৷ উল্লেখ্য এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ, যেখানে আজও ভ্রমণ করা যায়৷ প্রায় ষাটের অধিক প্রজাতির প্রবালের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে এই দ্বীপ সংলগ্ন জলে৷ এর বেশিরভাগই জীবন্ত, ২০ শতাংশের মতো ফসিল৷ যদিও দূষণের ধাক্কায় কিছু প্রজাতির প্রবাল আজ বিলুন্তির পথে৷ স্বভাবতই এই লোভনীয় দৃশ্যের সাক্ষী হতে পর্যটকগণ নীল জলের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেন না৷ Digital Camera

এই দ্বীপে বৈচিত্র্যময় ‘অলিভ রিডলে’ সহ তিন রকম প্রজাতির ছোট-বড় কচ্ছপ ও লাল কাঁকড়া সহ তিন চাররকম প্রজাতির ছোট-বড় কাঁকড়ার দেখা মেলে৷ এক ধরণের বড় কালো কাঁকড়ার পিঠেবিভিন্ন রঙের এমন সমাবেশ ঘটেছে, যা দেখলে মনে হবে কেউ বুঝি রঙ-তুলিতেচিত্রীত করেছে৷ এখানকার জলে প্রচুর ছোট-বড় তারা মাছ (সি-স্টার) দেখতে পাওয়া যায়৷ সারা বছর ধরেই শতাধিক প্রজাতির পাখিদের আনাগোনা এই দ্বীপে৷ এর অর্ধেকের বেশি পরিযায়ী পাখি৷ সাগরের নীল জলে ‘অ্যালগি’ (Algae) নামক শ্যাওলা গোত্রীয় এক ধরণের বিশেষ উদ্ভিদ পাওয়া যায়৷ ভেষজ গুণের জন্য মায়ানমারের লোকজনের কাছে এর বিশেষ চাহিদা৷ এছাড়াও এই দ্বীপের স্থলে ও সংলগ্ন জলে আড়াইশোর অধিক প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে৷ বেলাভূমির কোথাও কোথাও জলের ঢেউয়ে বালির স্তর ধুয়ে নীল জলের মাঝে মাঝে ছোট বড় শিলাখণ্ড অদ্ভুতভাবে মাথা উঁচু করে রয়েছে৷ উত্তরাংশে একটি নীলজলের লেক এইদ্বীপের আকর্ষণ আরও বাড়িয়েছে৷ সুতরাং এই দ্বীপে দৃষ্টিনন্দনকারী দৃশ্য ও বিস্ময়ের শেষ নেই৷

সম্পূর্ণ দ্বীপটিকে প্রশাসনিক ভাবে উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, মধ্যপাড়া এই ভাবে মোট পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে৷ হাজার চারেকপরিবার অনেকটা জায়গা নিয়ে কোথাও ঘন ঘন আবার কোথাও ফাঁকা ফাঁকা ঘর-বাড়ি করে বিদ্যুত্হীন এই দ্বীপে বসবাস করছে৷ বাড়ির চারিদিকে সরু সরু বাঁশ, চাটাই ওলটানো গাছ দিয়ে বেড়া দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়৷ রাস্তায় চলতে চলতে বেড়ার ভেতর থেকে চট্টগ্রামের বাংলা ভাষা প্রায়শই কানে প্রবেশ করে৷ আর সব রাস্তাই ঘুরেঘুরে শেষ পর্যন্ত সাগরের কিনারায় বালির মধ্যে থমকে গিয়েছে৷ saint_martin

এখানকার অধিবাসীরা মূলতঃ মত্‍স্যজীবী৷ যন্ত্রবিহীন বিভিন্ন ধরণের নৌকায় সাগরের নির্বিষ ঢেউয়ের মধ্যে মাছ ধরে৷ ছোট-বড় বেশির ভাগ মাছই শুকানো হয়, যা ‘শুঁটকি’ মাছ হিসেবে খ্যাত৷ চট্টগ্রামের লোকজনের কাছে এখানকার ‘শুঁটকি’র কদর খুব বেশি৷

চার-পাঁচ মাসের পর্যটন মরশুমকে কেন্দ্র করে এখানকার বাসিন্দাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে৷ পর্যটকদের প্রয়োজনীয় পসরা নিয়ে রাস্তার দু’ধারে দোকান, বেড়ানোর জন্য ছোট-ছোট সুদৃশ্য রিক্সাভ্যান এবং পৃথক বাথরুম, টয়লেটের ব্যবস্থা করে নিজেদের দু-একটা ঘর একটু সাজিয়ে গুছিয়ে দু-একদিনের জন্য ভাড়া দিয়ে তারা দু-পয়সা ‘মরশুমী আয়’ এর ব্যবস্থা করেছে৷ তাছাড়া থাকা-খাওয়া এবং শুধু খাওয়ার হোটেলের ব্যবস্থা তো আছেই৷ এই ধরণের হোটেল ব্যবসায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার লোকজন পুঁজি বিনিযোগ করতে শুরু করেছে৷

এই দ্বীপের নতুন প্রজন্মের কাছে শিক্ষার সুযোগ এসেছে৷ একটি করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সরকারি বিদ্যালয় আছে৷ বিদ্যালয় দু’টিই দোতলা পাকাবাড়ি৷ তবে কলেজের পড়ার স্বপ্ন দেখলে অবশ্যই সাগর পাড়ি দিতে হবে৷ প্রাথমিক চিকিত্সার ব্যবস্থা থাকলেও বড় সড় চিকিত্সার জন্যপাঁচ-ছ’ঘণ্টা সময় নিয়ে কক্সবাজার যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই৷

এই দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে এবং ভালোবেসে বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ সাগর পাড়ে কেয়া ও ঝাউবীথির মাঝে একটি সুদৃশ্য ঘর বানিয়ে দীর্ঘকাল সাহিত্য সাধনা করেছেন৷ এই প্রিয় বাড়িটির নাম তিনি দিয়েছেন ‘বৃষ্টি বিলাস’।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবেশদ্বার যদিও ‘টেকনাফ’। তবুও পর্যটকদের সরাসরি ওখানে না গিয়ে, উচিত হবে বিশ্ববন্দিত ‘কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত’-এ দুটো দিন কাটিয়ে যাওয়া৷ একশকুড়ি কিমি ব্যাপী পৃথিবীর দীর্ঘতম বেলাভূমি ‘কক্সবাজার’-এর একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে অনুচ্চ পাহাড়৷ মধ্যবর্তী অংশের বেলাভূমিকে কেন্দ্র করে বিভিন্নমানের থাকা ও খাওয়ার হোটেল৷ এখানে সমুদ্র স্নান, অর্ধশায়িত হয়ে সূর্যস্নান, বিপুল জলরাশির মাঝে সূর্যাস্ত উপভোগ করা, তেষ্টা মেটাতে সুস্বাদু ডাবের জল পান, সুন্দর পরিচ্ছন্ন বেলাভূমিতে বা ঝাউবনের মধ্যে একটু ঘুরে বেড়ানো-এসব হতেই পারে৷ তার পর ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপ’ যাওয়ার দিন ঠিক করাই ভালো৷

বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে প্যাকেজে দিনে দিনে ‘কক্সবাজার’ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বেড়িয়ে আসা যায়৷ আবার নিজ উদ্যোগে বাস ও জাহাজের টিকিট সংগ্রহ করে একই পথে যাতায়াত করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নিরিবিলি দুটোদিন কাটানো যায়৷ Kear-Sindbad-4-Saint-Martin

ভোরে ‘কক্সবাজার’ থেকে বাসে আশি কিমি দূরে ‘টেকনাফ’ পৌঁছতে হবে৷ কাছেই ‘মায়ানমার’ রাষ্ট্র হওয়ায় রাস্তায় বাংলাদেশ রাইফেলস এর অনেক চৌকি, উঁচু-নিচু পথ, ছোট-ছোট নদীর উপর ব্রিজ, জনপদ, জঙ্গল পেরিয়ে টেকনাফ পৌঁছতে ঘণ্টা আড়াই সময় লাগে৷ ১লা নভেম্বর থেকে ১৫ মার্চ অবধি ‘নাফ’ নদী র ‘দমদমিয়া’ জাহাজ ঘাট থেকে প্রতিদিন ৩-৪টি জাহাজ ছাড়ে সকাল সাড়ে৯টা থেকে দশটার মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে। দূরত্ব ৩৪ কিমি৷ এক একটা জাহাজে হাজার খানেক যাত্রী৷ তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে জাহাজে রেস্তোরাঁর ভালোই বন্দোবস্ত আছে৷ উল্লেখ্য, ১৫ মার্চের পর এই পথে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকে৷ জাহাজগুলো ‘নাফ’ নদীর উপকূল ছেড়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সাগরে পড়ে এবং দ্বীপে পৌঁছতে কমবেশি আড়াইঘণ্টার মতো সময় লাগে৷ আবার সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে বিকেল তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে জাহাজগুলো টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ এই জলপথে আপনার সঙ্গী হবে ‘সি-গাল’ এর ঝাঁক৷ একটু খাবারের লোভে মাইলের পর মাইল উড়ে চলে জাহাজের পাশে পাশে৷ আবার কখনও ক্লান্তহয়ে নীলজলের ঢেউয়ে ভাসতে থাকে৷ যাত্রীরা এই দৃশ্য উপভোগ করতে জাহাজের ছাদে উঠে পড়ে৷ দ্বীপে পৌঁছে প্যাকেজের যাত্রীদের তাড়াতাড়ি রিক্সা ভ্যানে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে এক চক্কর দিয়ে নির্ধারিত হোটেলে সুস্বাদু রূপচাঁদা মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরে আহার সেরে একটা সুমিষ্ট ডাবের জল পান করে ফেরার জাহাজে গিয়ে বিশ্রাম করতে পারেন৷ আর যদি নির্জন দ্বীপ আরও ভালোভাবে উপভোগ করতে চান বা প্রবালের খোঁজে নীলজলে নামতে চান এবং দ্বীপের বাসিন্দাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে চান, তাহলে বিদ্যুত্হীন এই দ্বীপে দু’টো দিন আপনাকে থাকতে হবে৷ তবে যা দেখবেন এবং উপভোগ করবেন তা আপনার স্মৃতির মণিকোঠায় বহুদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়৷

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading