ফলে মেশানো রাসায়নিকের প্রভাব পড়ছে পরিবেশেও

আবুল খায়ের

   ফলে যে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহূত হচ্ছে তার প্রভাব সরাসরি মানবদেহেই নয় বরং পরিবেশের উপরও পড়ছে। ফল উত্পাদনকারী এলাকার গবাদি পশু, জলাভূমি ও ফসলের ক্ষেতে পড়ছে কেমিক্যালের প্রভাব। দিনাজপুরে গত বছর বিষাক্ত লিচু খেয়ে ১৩ শিশুর মৃত্যুর পর এবার টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ৩৭টি গ্রামে ঘরে ঘরে বিভিন্ন জটিল অসুখ বিসুখ দেখা দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। এমনকি কেমিক্যালের প্রভাবে ওই গ্রামগুলোয় হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলও মারা পড়ছে বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বড় বড় ফল ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় স্থানীয় ফল চাষিদের বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানোর উত্সাহ দেয়। জেনে না জেনে চাষিরা ফলে দেয় এসব কেমিক্যাল। অনেক সময় চাষিরা কেমিক্যাল ব্যবহারের নিয়ম ও এর ক্ষতিকর দিক না জেনেই যত্রতত্র ফলে কেমিক্যাল দেয়। এভাবে গাছে মুকুল আশার পর থেকে ফল তোলার আগ পর্যন্ত ১৬ ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করে চাষিরা। এরপর সেই ফল টাটকা ও তরতাজা রেখে বিক্রির উদ্দেশে কয়েকদফা মেশানো হয় কেমিক্যাল। distributor-pupuk

জানা গেছে, মধুপুর উপজেলার ফল উত্পাদনকারী ৩৭টি গ্রামে ভারত থেকে চোরাই পথে আনা বিষাক্ত কেমিক্যালের প্রভাবে এলাকার ঘরে ঘরে নানা জটিল রোগ দেখা দিয়েছে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলসহ অন্যান্য জীবজন্তু মারা যাচ্ছে। ওই সব গ্রামে জন্ম নেয়া শিশুরাও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

গোপালপুরের সংবাদদাতা জয়নাল আবেদীন জানান, ফল ও সবজি চাষে যত্রতত্র কেমিক্যালের ব্যবহারে মধুপুর গড়ের ৩৭টি গ্রাম বিষের জনপদে পরিণত হয়েছে। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ কৃষি বিভাগ জানায়, বৃহত্তর ময়মনসিংহের গড় এলাকার মধুপুর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, ঘাটাইল, ভালুকা, সখিপুর ও জামালপুর সদর উপজেলায় ৩০ হাজার একর জমিতে আনারস, ১৩ হাজার একর জমিতে কলা, ৮ হাজার একরে কাঁঠাল, দুই হাজার একরে কুল, দেড় হাজার একরে জলপাই, এক হাজার ২০০ একরে পেঁপে, ৬০০ একরে পেয়ারা, ৩০০ একরে লিচু এবং ৮ হাজার একর জমিতে হলুদ ও আদাসহ নানা ধরনের মসলার বাণিজ্যিক আবাদ হয়। স্থানীয় কৃষক ছাড়াও বড় বড় ব্যবসায়ীরা বন্দোবস্ত নেয়া জমিতে গড়ে তুলেছে ফল, সবজি ও মসলার বাণিজ্যিক খামার। স্বল্পসময়ে বেশি উত্পাদনের লক্ষ্যে খামারিরা কেমিক্যাল কোম্পানির পরামর্শে পোকামাকড়, বালাই দমন এবং ফল বিপণন ও পাকানোর কাজে কেমিক্যাল ব্যবহার করছে।

সাধু পাড়ার আনারস চাষি অমিত সাংমা জানান, বহিরাগত ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফল চাষ শুরুর পর কেমিক্যাল কোম্পানির লোকেরা গ্রামে ভিড় জমায়। তারা অমৌসুমে গাছে ফুল, ফল ও সবজি আনয়ন, আকার বড় ও জীবন চক্র কমাতে গ্রোথ হরমোন এবং ফল দ্রুত পাকাতে রাইপেন হরমোন প্রয়োগের রেওয়াজ চালু করে। বড় চাষিদের দেখাদেখি ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরাও পরিবেশ বিনাশী ফাঁদে পা দেয়। ভেদুরিয়া গ্রামের নুপক মাংসাং জানান, গ্রাম জুড়ে চাষ হওয়া ফল আর সবজির পোকামাকড়, রোগবালাই দমন এবং উত্পাদন বৃদ্ধিতে ক্যারাটেসহ দীর্ঘ ক্রিয়াশীল বিষ ও কেমিক্যাল নির্বিচার প্রয়োগে বিষের গন্ধে গ্রামে টিকা দায়। গ্রামে ঢুকলেই বিষের গন্ধে মাথা ঘুরে। বমি আসে। সাধুপাড়া ও ভেদুরিয়ার আশপাশের ৩৭টি গ্রামের চিত্র কমবেশি এমনই। দেশি-বিদেশি ৫৩টি কোম্পানি নানা ব্র্যান্ডের সহস্রাধিক বালাইনাশক, হরমোন, তরল ও সুষম সার বাজারজাত করে বার্ষিক ৫০/৬০ কোটি টাকার মুনাফা করে। মধুপুর উপজেলায় সরকারি বালাইনাশক ডিলার ৬৫ এবং কেমিক্যাল কোম্পানির নিজস্ব ডিলার দেড় শতাধিক। এদের উপর কৃষি বিভাগের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল তৃণমূল পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে অবাধে। কৃষি বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই গ্রামগঞ্জে গড়ে উঠেছে অবৈধ কৃষক পরামর্শ কেন্দ । বায়ার ক্রপ সাইন্সের মার্কেটিং অফিসার সুমন পারভেজ জানান, তার কোম্পানির বিষ ও কেমিক্যাল বিক্রির সুবিধার্থে একাধিক কৃষক পরামর্শ কেন্দ চালু করা হয়েছে। বায়ার ক্রপের দেখাদেখি সিনজেন্টা, এগ্রোপ্রোডাক্ট, ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ারসহ ৮/১০টি কোম্পানি একই কায়দায় কেমিক্যাল বিপণন করছে।

টাঙ্গাইল কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দীন এবং মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. হযরত আলী সমপ্রতি অরনখোলা ইউনিয়নের কুড়াগাছা গ্রামে দি লিমিট এগ্রোপ্রোডাক্টের নিষিদ্ধ দানাদার ডায়াটন ১০জি সবজিতে প্রয়োগ করতে দেখেন। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ জানান, বালাইনাশক ও কেমিক্যাল কোম্পানি কৃষকদের বিভ্রান্ত করে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল, হরমোন এবং নিম্নমানের সার গছিয়ে দিয়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. হযরত আলী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, সীমিত ক্ষমতা ও লোকবল নিয়ে এসব অনিয়ম প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।

আমাদের সিলেট অফিস জানায়, আম, জাম, কাঠাল, আনারস টাটকা রাখতে দফায় দফায় নানা জাতের বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে থাকে। একই ভাবে অন্যান্য ফলেও রয়েছে ফরমালিনসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল। এদিকে বিষাক্ত ফলসহ নানা ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব হলেও অজ্ঞাত কারণে সিলেটের বিএসটিআই রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। সিলেটের ফলের প্রধান প্রধান বাজার ও আড়তগুলোতে চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত কোন অভিযানই তারা চালায়নি। অভিযোগ রয়েছে, বিএসটিআই এর কতিপয় অসাধু কর্তাব্যক্তি ভেজাল বিরোধী মোবাইল কোর্টের পরিবর্তে নিজেদের পকেট ভারি করতে অন্য ধান্ধায় ব্যস্ত।

সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক (২৮/০৬/২০১৩)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *