বিশ্বের রোমান্টিকতম হ্রদ ; লেক ব্লেড

 

তারেক অণু

9834595986_7563d23456

স্লোভেনিয়ার গাইড বই মানেই মলাটে একটা অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ি হ্রদের ছবি থাকবে, দেখা যাবে দিগন্তে তুষার ছাওয়া আল্পস, চারিদিকে পান্নাসবুজ বন, নীলার মত স্বচ্ছ নীলাভ সেই হ্রদের জল, যার মাঝখানে আছে রূপকথার এক দ্বীপ! সেই দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক দ্বীপ। সেখানে হীরের ফুল, মুক্তোর ফল নেই বটে কিন্তু মাথা উচিয়ে আছে এক স্থাপত্য যা ঘিরে আছে উঁচু উঁচু স্বর্গীয় গাছ। কোথায় এই হ্রদ?

9834602926_1c8b50f64e

9834566834_fce9bb763c

সাধারণত কোন দেশের গাইড বইয়ের মলাটে ঘুরে ফিরে সেই দেশের রাজধানীর কোন এক সুপরিচিত আকর্ষণের কথা স্থান পায়, কিন্তু স্লোভেনিয়ার ব্যাপার আলাদা, এখানে রাজধানী লুবলিয়িনা নয়, সবসময় এই ক্ষেত্রে জয়ের মুকুট শোভা পায় এই পাহাড়ি হ্রদ, শহরের সাথেই নাম মিলিয়ে যার নাম লেক ব্লেড, এবং নৈসর্গিক দৃশ্যের সাথে সাথে মাঝে মানব সৃষ্ট স্থাপত্য মিলে তৈরি করেছে এক নিখুঁত দ্যোতনা, যার কারণে বিশ্বের রোমান্টিকতম হ্রদ হিসেবে লেক ব্লেডকে অভিহিত করা হয় প্রায়শই।

9834589675_5915498d9d

9834559614_9eb995bfc2

এই বছরেরই এক রোদেলা বিকেলে স্লোভেনিয়ার বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর মানসিক প্রস্ততি ছিল লুবলিয়ানা যেয়ে বাসে চেপে ৫৫ কিলোমিটার দূরের ব্লেড শহরে যাওয়া, বিখ্যাত সেই হ্রদের তীরেই অবস্থিত একই নামের পার্বত্য শহরটি। কিন্তু উড্ডয়নযন্ত্রের পোতাশ্রয়ের বাহির হতেই দেখা মিলল সারি সারি মাইক্রোবাসের যারা সরাসরি ব্লেড যাবে, ফলে সময়, পরিশ্রম, অর্থ সবকিছুর অযাচিত সাশ্রয় তো হলই, সেই সাথে মিলল পাহাড়ি রাস্তায় সিঁদুররঙা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে দেখার অপূর্ব অভিজ্ঞতা। ব্লেড এমন কোন আহামরি বড় শহর নয়, বরং হ্রদটির কারণেই লাখ লাখ পর্যটক আসে সেখানে ফি বছর, তাদের উপর ভরসা করেই গড়ে উঠেছে পর্যটন, বলা চলে বাসভবনের চেয়ে হোটেলের সংখ্যা কোনমতেই কম না সেখানে। এখানের সবচেয়ে বিখ্যাত নিয়মিত পর্যটক ছিলেন সাবেক যুগোস্লাভিয়ার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা মার্শাল তিতো।

9834678413_900255985c

9834680643_358e6f7953

হোস্টেলে ব্যাগ রাখার সময়ই হোস্টেলের রিসেপসনিস্ট নীনার কাছে জানা গেল স্বপ্নের সেই লেক ব্লেড মাত্র ২০০ মিটার দূরেই অবস্থিত, তৎক্ষণাতই পদব্রজে রওনা হলাম নীনারই বান্ধবী আলিয়ার সাথে, এই প্রসঙ্গে বলে রাখি স্লোভেনিয়ার মানুষেরা বিশেষ করে বালিকারা খুবই বন্ধুত্বপরায়ণ এবং আবেদনময়ী, এবং পানশালায় তারা প্রবেশ করতে পারে ১৫ বছর বয়স থেকেই! যা হোক, হাটি হাটি পা পা করে পৌঁছানো হল রোমান্টিক হ্রদের ফেনিল কিনারে, সারি সারি স্পেশাল ব্লেড নৌকা যেন অপেক্ষায় রয়েছে স্বপ্নালোকে যাত্রা শুরুর জন্য, পুব থেকে ছেয়ে আসা আঁধারে হ্রদের জলের আসল টলটলে রঙ বোঝা গেল না যা কিনা হিমবাহ হ্রদের আসল সৌন্দর্যের উৎস।

9834558334_f3c1442d42

সত্যি বলতে প্রথম দর্শনে কিছুটা হতাশই হয়েছিলাম লেক ব্লেড দর্শনে, সায়মা হ্রদের বুকে কাঁপন তোলা ভয়াল বিশালতা নেই তার, নেই ইনারি হ্রদের বিধ্বংসী তরঙ্গ, বা বৈকালের অতল গভীরতা , টিটিকাকার একক সংস্কৃতি, কেমন যেন শান্ত, স্থির, নীরব, মৌন প্রেমিকের মত, টলটল করে চেয়ে থাকার মাঝেই যার জীবনের সকল উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিহিত।

9834565534_c11186b19f

তবে আলিয়া জানাল আমরা পুরো হ্রদের মাত্র অর্ধেক দেখতে পাচ্ছি, দৃষ্টি বাঁধা পাচ্ছে মাঝের দ্বীপে! বাকী অর্ধেক একসাথে দেখতে চাইলে পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত দুর্গে যেতে হবে! প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ আর দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত হ্রদ এবং তার মাঝে অবস্থিত মহাগুরুত্বপূর্ণ দ্বীপটি একইসাথে পাখির চোখে দেখার এবং ক্যামেরার চোখে ধারণ করার উদ্দেশ্য পরদিন কাক ভোরে চললাম দুর্গের দিকে, সূর্যদেবের মঙ্গলবার্তা বহনকারী রশ্মিতীরেরা ইতিমধ্যেই আল্পস পেরিয়ে ব্লেড জনপদ আলোকিত করা শুরু করেছে, একটু পরেই তার চোখ ধাঁধানো রথ আসবে সমগ্র গ্রহকে আলোকিত করতে।

1117_10152943318685497_1619210410_n

পাকদণ্ডী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠতে উঠতে মাঝেই প্রাকৃতিক লীলাখেলার সেই সন্নিবেশনের সাক্ষী হবার জন্য থামত হচ্ছিল বারবার, অবশেষে মধ্যযুগের ব্লেড দুর্গের ফটকে পৌঁছাতেই মুখ থেকে অনর্গল খাঁটি বাঙ্গালী গালি বাহির হওয়া শুরু হল, কারণ আর কিছুই না দুর্গতোরণ সকাল নয়টার আগে খোলা হবে না ! অথচ সেই সময়ের তীব্র রোদে কোন ভাল ছবিও আসবে না, কাজেই আবার কেচে গণ্ডূষ করতে হবে হ্রদের কিনারে যেয়ে।

524346_10153088307315497_244034971_n

1016612_10152958121820497_97967045_n

হ্রদ তখন পরিণত হয়েছে সবুজ রঙা টলটলে তরল ভর্তি এক বিশাল কাপে, যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাছের ঝাঁক,

1010732_10152945154115497_678299283_n

মা নীলশির হাঁসের পেছনে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার শিক্ষা আহরণে ব্যস্ত তুলতুলে ছানারা।

1045184_10152943864495497_1181667327_n

প্লেতনা নামের বিশেষ নৌকারাও যাত্রা শুরু করেছে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক দ্বীপটির দিকে। হ্রদের একাধিক জায়গা থেকে এমন কাঠের তৈরি নৌকায় ওঠা যায়, কিন্তু যেখান থেকে তা ছাড়বে ঠিক সেখানেই আবার এনে নামিয়ে দেবে, অন্য গন্তব্যে নিয়ে যাবে না, সব মিলিয়ে ঘণ্টাখানেকের ভ্রমণ, আধা ঘণ্টা সবুজ স্নিগ্ধ জলে, বাকীটা সময় দ্বীপে। সবুজ কেটে চলল আমাদের আমাদের মাঝি।

254681_10153088307170497_2053542764_n

১৫৯০ থেকে এই বিশেষ কেঠো নৌকার ব্যবহার শুরু হয়, যা কেবলমাত্র এই একটি হ্রদেই দেখা যায়। সম্পূর্ণ সমতল পাটাতনের নৌকাটিতে প্রবেশের পথ মাত্র একটা থাকে, সাধারণত ২০ জন আরোহী একসাথে যেতে পারে, যদিও নির্দিষ্ট সময় পরপরই মাঝি নৌকা চেয়ে দেয়, আবার চাইলে পুরো নৌকাও ভাড়া করার ব্যবস্থা আছে। একজন একই সাথে দুইটা দাড় দিয়ে নৌকা চালাতে পারে। বংশ পরম্পরায় কিছু পরিবারের লোকেরাই ব্লেড হ্রদের মাঝি হয়ে আসছে সবসময়, যাদের বলা হয় Pletnarstvo । স্থানীয়দের কাছে এটি অতি সন্মানিত এক পেশা। প্রতিটি নৌকার আলাদা আলাদা নামও আছে!

1003955_10152968353570497_1720702124_n

রোয়িংএর জন্য হ্রদটি অতি জনপ্রিয়, গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিযোগিতা হয় এখানে, এমনকি বিশ্ব রোয়িং প্রতিযোগিতা হয়েছে তিন তিন বার! আমাদের সামনেই কজনা ছিপছিপে নৌকা নিয়ে দাঁড় চালিয়ে চোখের নিমিষে চলে গেল হ্রদের অন্য প্রান্তে। এছাড়া ছিল মাছ ধরা জেলেদের নৌকা। আর স্নানার্থীরা। তাদের মাঝে দিয়েই জ্বলজ্বল সবুজ মখমল জল চিরে পৌঁছে গেলাম দুর্গের নিচ দিয়ে বিখ্যাত দ্বীপটাতে, হাজার দ্বীপের দেশ ফিনল্যান্ড থেকে বেড়াতে এসেছি একটি মাত্র দ্বীপের দেশ স্লোভেনিয়াতে, ব্যাপারটি কিছুটা কৌতুককরও বটে! দূরের জুলিয়ান আল্পস, কাছের দুর্গ আর আধুনিক নগরী , মাঝের বন মিলিয়ে স্থানটির বিশেষত্ব আরও ফুটে ওঠে দ্বীপের মাঝখানে গেলে।

971489_10152968353315497_787419713_n

সেখানে এক গির্জাতে বিয়ে পড়াবার সময় বর কনে বহন করে ৯৯টি সিঁড়ি ভেঙ্গে, স্থানীয় সংস্কার বশে। সেখান থেকে দুর্গর অন্য অংশটিরও দেখা মিলল যা ভোরের বেরসিক নিয়মের কারণে চাক্ষুষ করতে পারি নাই।

539638_10153103375440497_1921530788_n

মিনিট বিশেক ক্লিক ক্লিক করে, গির্জা প্রাঙ্গণের চমৎকার আইসক্রিম খেয়ে , আবারও ফেরার পথে। অন্যদের সাথে দেখা হল যারা আমাদের মতই এসেছে লেক ব্লেডের সুবিদিত সৌন্দর্যে অবগাহনের জন্য।

1148870_10153103375560497_1150641097_n

দেখা মিলেছিল ক্ষুদে অন্য ধরনের নৌকার মাঝে রাজহাঁস আকৃতির নৌকার সাথেও !

1017148_10152986024505497_2047210971_n

1003436_10152955006275497_2034738985_n

তীরে ফিরেই একটা ট্যুর কোম্পানিতে যাওয়া হল যদি আল্পসে হাঁটার কোন গ্রুপে আজকের জন্য যাওয়া যায়, মূল আকর্ষণ সেই পথের মাঝখানে একটি উঁচু পাহাড় যেখান থেকে লেক ব্লেডের প্যানরোমা তোলা সম্ভব হবে পিছনে আল্পস পর্বত আর মাঝের দ্বীপসহ। কিন্তু বিধিবাম, যে কয়টি ট্যুর আছে সবই ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার, একটা আবার ইতালির ভিতর দিয়ে, আর আমার সেই দুপুরেই ৩ ঘণ্টা পরে যেতে হবে জাগরেবের ট্রেন পাকড়াতে। কাজে কাজেই এই যাত্রা লেক ব্লেড আর জুলিয়ান আল্পসকে হাসতা লা ভিসতা বেইবি বলে ক্রোয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে হল।

কাজে কাজেই বুঝতেই পারছেন পোস্টের প্রথম ছবিটা আমার তোলা না, নেট থেকে সংগৃহীত, কিন্তু সেটাই লেক ব্লেড বা স্লোভেনিয়ার সবচেয়ে পরিচিত আলোকচিত্র। আর শেষ ছবিটাও আমার তোলা না, নৌকার মাঝি ভাইয়ের তোলা।

লেখকঃ গবেষক, প্রকৃতিপ্রেমী এবং পর্যটক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *