পুরাতন ব্রহ্মপুত্র: নদী, নিরাপদ পানি ও মানুষের গল্প

জওহর দুদায়েভ, দিবস দেব, স্কলাস্টিকা আরেং, আরিয়ান ইমন

বৈশ্বিক মহামারীর এই দূর্যোগকালীন মুহুর্তে সুপেয় পানির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি নতুন করে আমাদের সামনে এসেছে। অধিকাংশ উন্নয়নশীল কিংবা স্বল্পোন্নত দেশকে তার নাগরিকদের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ৬০% মানুষ দূষিত পানি গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। সুপেয় পানির জন্য দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের দৃশ্যটা শহর কিংবা গ্রামভেদে অনেকটা একইরকম। শহুরে বস্তি কিংবা অনুন্নত গ্রামগুলোতে আমরা দেখতে পাই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য সুপেয় পানির উৎসের পরিমান খুবই নগন্য। কোরোনাকালীন দূর্যোগে আমরা যখন সামাজিক দূরত্বের উপর জোর দিচ্ছি, তখন দেখা যাচ্ছে সুপেয় পানির জন্য মানুষের লড়াই আগের মতই আছে, জনসমাগম কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাছাড়া নিয়মিত হাত ধোয়া, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি ব্যবহারযোগ্য পানির অভাবে ঠিকমত পালন করা যাচ্ছে না, এতে কোরোনা ঝুকি বাড়ছে। অথচ নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটা বড় অংশের জন্য দূষণমুক্ত নদী হতে পারতো নিরাপদ পানির উৎস। কয়েক দশক আগেও নদী ছিলো প্রান্তিক মানুষের পানির চাহিদা মেটানোর অন্যতম অবলম্বন। কিন্তু নানাবিধ মনুষ্যসৃষ্ট কারনে মানুষ বিকল্প উৎসের দিকে ঝুকতে বাধ্য হয়েছে। এভাবে সময়ের সাথে মানুষ ও নদীর মাঝে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। নদী ও নদী নির্ভরশীল মানুষের এই দূরত্বের কারন খুজতে আমরা ৪ সদস্যের একটি দল কাজ করেছি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে। সেখানে আমরা শুনেছি নদীর কথা, দেখেছি নদী-মানুষের সম্পর্কের উত্থান-পতনের চিত্র।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, ময়মনসিংহ

আমাদের এই দল গঠনের গল্পটা খুবই আকর্ষণীয়। চারজন তরুন, দিবস দেব, আরিয়ান ইমন, স্কলাস্টিকা আরেং, জওহর দুদায়েভ, দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক হয়েছিলাম শুধুমাত্র নদীর জন্য, নদী নির্ভরশীল মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য। ২০১৮ সালে অক্সফ্যামের ট্রোসা প্রোজেক্টের কর্মসূচির আওতায় তরুণদের নদী গবেষনায় উদ্বুদ্ধ করতে সিএনআরএস (সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ) একটি কর্মশালার আয়োজন করে। সেখানে আমরা নদী নিয়ে গবেষণার নানান পদ্ধতি এবং প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা পেয়েছিলাম। আমাদেরকে কোনো একটি নদী ও নদীর মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে গবেষণার প্রস্তাবনা দিতে বলা হয়েছিলো। আমরা বেছে নিয়েছিলাম পুরাতন ব্রহ্মপুত্রকে। ঘটনাচক্রে আমরা চারজনই পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষ। আমাদের জীবনের সাথে নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শৈশব কৈশোরের দূরন্তপনা, বন্ধুদের সাথে দলবেধে নদীতে গোসল, আড্ডা, নৌকা বাইচ দেখতে যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো এসব ছিলো প্রায় প্রতিদিনের দৃশ্য। কিন্তু সেই পরিবেশ এখন আর নেই, দূষনের কারনে নদীতে গোসল অস্বাস্থকর, নৌকা বাইচের সংস্কৃতিও হারিয়ে গেছে। অতীতের সেই স্মৃতিগুলোই আমাদেরকে নদীর জন্য, নদীর নির্ভরশীল মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছে।

তরুণ নদী গবেষক দল; বা থেকে জওহর দুদায়েভ, আরিয়ান ইমন, স্কলাস্টিকা আরেং এবং দিবস দেব।

এবার মূল গল্পে ফেরা যাক। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের গাইবান্ধা, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার একটি নদ। এটি জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে শাখা হিসেবে বের হয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলায় মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে। ময়মনসিংহে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের একপাড়ে শহর, অন্যপাড়ে গ্রাম। আমাদের গবেষণা ছিলো গ্রামাঞ্চল কেন্দ্রিক। শহর থেকে বিভিন্ন ড্রেইন সরাসরি কোনো প্রকার শোধন ছাড়াই নদীর সাথে যুক্ত হয়েছে। এছাড়াও নদীর পাড়ে তৈরি করা অস্থায়ী ভাগাড়ে শহরকেন্দ্রিক বর্জ্যের একটা অংশ জমা করা হয়। আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছিলো এই দূষণ কি নদীর সাথে মানুষের দূরত্ব তৈরি করছে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুজতে মাঠ পর্যায়ে আমাদের গবেষনা কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৯ সালের এপ্রিলে।

সরাসরি নদীতে সংযুক্ত সিটি কর্পোরেশনের ড্রেইন

সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে আমরা জানতে পারলাম, পনেরো বিশ বছর আগেও মানুষ অধিকাংশ দৈনন্দিন কাজে নদীর পানি ব্যবহার করতো। তখন নদীর পানি ছিলো স্বচ্ছ, ব্যবহারযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে উজানের দূষণ ও ময়মনসিংহ শহরের অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারনে নদী দূষিত হচ্ছে। নদী পারাপার, এমনকি নদীর পাশ দিয়ে হেটে গেলেও মানুষ কিছুটা বাজে গন্ধ পাচ্ছেন। দূষণের কারনে বিগত বছরগুলোতে মানুষ নদীর পানির বিকল্প খুজতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা সেখানে দেখতে পেয়েছি, কয়েকটি পরিবার মিলে একটি টিউবওয়েল ব্যবহার করছে। দূষণ থাকা সত্ত্বেও এখনো কিছু মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজের জন্য নদীর পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা জানান, নদীর পানিতে গোসল করায় তাদের ত্বকে নানান রকম উপসর্গ দেখা দিচ্ছে।

নদী তীরবর্তী বাসিন্দা, অঞ্জলি রাণী বীণ আমাদের জানান, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ নদের রয়েছে ধর্মীয় তাৎপর্য। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এ নদের পানি পবিত্র, নদীতে গোসল তাদের পাপমোচন করবে। তাই নদীতে দূষণ দৃশ্যমান হলেও এ বিশ্বাসের কারনে তারা কখনোই নদীকে দূষিত বলেন না।

প্রতি বছর ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পূন্যস্নানে অংশ নেন ময়মনসিংহ ও তার আশেপাশের কয়েকটি জেলার অধিবাসীরা। নদী দূষণের কারনে তাদের অনেকেই গোসল করতে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করেন। দূষণ কিভাবে মানুষের ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্ন করে এই ঘটনা থেকে তা উপলব্ধি করা যায়। দূষণের উৎস হিসেবে গ্রামের অধিকাংশ মানুষই শহর থেকে নদীতে সংযুক্ত হওয়া ড্রেনের বিষয় উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ নদীর শহর অংশের পাড়ে অবস্থিত অস্থায়ী ময়লার ভাগাড়ের কথাও বলেছেন। বর্ষাকালে নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে এসব ময়লা নদীতে ভেসে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, গ্রামের মানুষেরা তাদের গৃহস্থালী বর্জ্য ঘরের পেছনে গর্তের ভেতর পুতে রাখে কিংবা পুড়িয়ে ফেলে। নদী দূষণের সাথে তারা কোনোভাবেই জড়িত নয়।

নদীর পাড়ে অস্থায়ী ভাগাড়

সরেজমিনে আমরা নদীর পাড়ে গিয়ে প্রায় আঠারোটির মত কার্যকর ড্রেইন এবং দুইটি অস্থায়ী ময়লার ভাগাড় চিহ্নিত করেছি। এছাড়াও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি উজানের জেলা জামালপুরে শহুরে বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে।

নদী দূষণ ও এর প্রভাবে মানুষের সাথে নদীর দূরত্ব তৈরির বিষয়ে আমরা ময়নসিংহ শহরের বিশিষ্টজনদের সাথে কথা বলেছি। সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জনাব ইকরামুল হক টিটুর ভাষ্যমতে, কলকারখানা উদ্ভুত না হওয়ায় ড্রেনের তরল বর্জ্য তেমন গুরুতর কিছু নয় । ভবিষ্যতে যদি কখনো শোধনাগার স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তারা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন।

দূষণের এই চিত্র শুধু পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের না, সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নদীরই। কোরোনাকালীন এই দূর্যোগে দূষণমুক্ত নদী হতে পারতো দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপদ পানির অন্যতম উৎস। আমরাই দূষণের মাধ্যমে মানুষকে অন্য উৎসের দিকে ঝুকতে বাধ্য করেছি।

নদী ও নদী নির্ভরশীল মানুষের দূরত্ব কিভাবে তৈরি হয় সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়েছি। এবার আমাদের লক্ষ্য নদী নির্ভরশীল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নদীর উপর তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে পাশে থাকা, কারন আমরা বিশ্বাস করি একমাত্র দূষণমুক্ত নদীই আমাদের সুপেয় ও ব্যবহারযোগ্য পানির চাহিদা মেটাতে পারে।

(মূল লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে অক্সফ্যাম ইন এশিয়ার ব্লগে। লিংকঃ https://asia.oxfam.org/latest/blogs/old-brahmaputra-story-reliance)

Check Also

অসাধু ব্যবসায়ীক চক্রেই ভেজাল ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা সাধারণ

পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট এর ফল পরীক্ষার তথ্যানুযায়ীই বলতে হয় যে, এ দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল এবং দেহের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর বলেই চিহ্নিত হয়েছে। সারা দেশ থেকেই স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্য দ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাস্তা রঙ !

সাদা এই আস্তরণের উন্নতি এর দাম কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। এছাড়াও এর ফলে ঘর শীতলীকরণ প্রক্রিয়ার ব্যবহার কমবে। যেমন এয়ার কন্ডিশনের ব্যবহার কমার ফলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়াও সাদা আস্তরণের ফলে সন্ধ্যা হতেই রাস্তার বাতি জ্বালানো লাগছে না। এখানেও জ্বালানি শক্তির সাশ্রয় করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *