এশীয় শাবুলবুলি : লম্বা লেজে যায় চেনা

 বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, শ্রীমঙ্গল :

Capture
শিকার ধরার অপেক্ষায় এশীয় শাবুলবুলি। ছবি : রেজাউল হাফিজ রাহী”

পাখি বলতেই তার সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে। তবে এই মুগ্ধতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়- এমন পাখি প্রথমবারের মতো দেখার সুযোগ হয়েছিল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। মুগ্ধতার পাশাপাশি বেশ অবাকও হয়েছিলাম। স্বগতোক্তি বেরিয়ে এসেছিল- সুন্দর, তাই বলে এত্ত সুন্দর! আর সেই পাখিও এই বাংলাদেশেই আছে। উদ্যানে গাছের উঁচু ডালে কিছু সময় বসে হঠাৎই চোখের আড়াল হয়ে গেল। পাখা মেলে দিল গহিন বনের দিকে। সুদীর্ঘ লেজ পাখিটির শারীরিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। লেজের জন্যই ছোট আকারের ঝুঁটিওয়ালা পাখিটি অন্য পাখি থেকে সহজেই আলাদা করে চেনা যায়। চুলের ফিতার মতো লেজের দুই দীর্ঘ পালক দুই দিক দিয়ে ঝুলে থাকে। যেনবা লতাগুল্মের কোনো অংশবিশেষ। বিশাল লেজের চোখ জুড়ানো এই বাহারি রূপ অরণ্য ভ্রমণের যেন এক অনন্য উপহার।
অপরূপ সুদর্শন বলেই হয়তো ইংরেজিতে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্বর্গীয় পাখি’ মূলত পাখিটির নাম ‘এশীয় শাবুলবুলি’ ইংরেজি নাম Asian Paradise Flycatcher । বৈজ্ঞানিক নাম Terpsiphone Paradisi। তবে অঞ্চলভেদে দুধরাজ, সাহেব বুলবুলি, শাহ বুলবুল, সুলতান বুলবুল প্রভৃতি নামেও পরিচিত। এরা ঘাস, লতাপাতা, মাকড়সার জাল দিয়ে পেয়ালা আকৃতির খুব সুন্দর বাসা বানায়। সাধারণত পুরুষ ও মেয়ে পাখি উভয়ই লাল রঙের হয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো পুরুষ পাখি আবার ধবধবে সাদা রঙেরও হয়। তবে এদের সংখ্যা কম।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি এবং স্বনামধন্য পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছেলেপাখিদের গায়ের রং কোনোটার সাদা; আবার কোনোটার লাল। তবে সাধারণভাবে মানুষ সাদা পাখিটিকে ভিন্ন প্রজাতির পাখি বলে মনে করে। দুধের মতো ধবধবে সাদা বলে একে কেউ কেউ ‘দুধরাজ’ বলেও ডাকে। তবে আমরা এই নামটা গ্রহণ করিনি। কারণ এতে লোকজনকে ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলের লোকেরা পাখিটিকে শাবুলবুলি বলেই ডাকে। এশিয়ার বাইরেও ভিন্ন শাবুলবুলি পাখি রয়েছে। পার্থক্যটা পরিষ্কার করে বোঝার জন্য তাই আমরা এই পাখির নাম দিয়েছিÑ ’এশীয় শাবুলবুলি’।
ইনাম আল হক বলেন, ‘অপরূপ সৌন্দর্যে আধার পাখিগুলো উড়ে উড়ে প্রজাপতি, ফড়িং ও ছোট পোকা শিকার করে খায়। গলার স্বর কর্কশ। সাধারণত বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এদের বেশি দেখা যায়। আমগাছের আধিক্য আছে এমন এলাকায় এশীয় শাবুলবুলি বেশি দেখা যায়। আমগাছের ডালেই এরা মাকড়সার জাল দিয়ে ঘাস, পাতা, আঁশ জড়িয়ে গোল করে খুব সুন্দর বাসা বানায়। এরা মাকড়সার বাচ্চার পরিত্যক্ত সাদা থলে সংগ্রহ করে এনে বাসার চারদিকে খুব সুন্দর করে লাগায়। বাসায় বসার পর পাখিটির লেজ বিশেষ ভঙ্গিমায় বাইরে ঝুলে থাকে। তিনি আরো জানান, এশীয় শাবুলবুলি বর্ষা মৌসুমে বাসা বানিয়ে দুই থেকে চারটি ডিম পাড়ে। ১৫-১৬ দিনে ডিম ফুটে ছানা বের হয়। বর্ষা মৌসুমে আমগাছে পোকার আধিক্য বেশি থাকে বলে খাবারের প্রাচুর্যের সুযোগে এ সময়টাতেই ওরা বাচ্চা ফুটায়।’
এশীয় শাবুলবুলির সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাওয়া প্রসঙ্গে ইনাম আল হক বলেন, ‘একটা বড় অসুবিধা হলো- এরা অনেকটা মানুষের নাগালের মধ্যে বাসা তৈরি করে। ফলে অতি উৎসাহী ছেলেমেয়েরা পাখিগুলো সহজেই ধরে ফেলতে পারে। কিংবা কৌতূহলবশত পাখির বাসাটা নষ্ট করে দেয়। নিচে বাসা তৈরি করে বলে বিভিন্ন এলাকার আদিবাসীদের হাতে এরা যথেষ্ট পরিমাণে মারা পড়ে। আমি দেখেছি- চা শ্রমিকের ছেলেরা বল্লমের মতো একটি জিনিস নিয়ে খোঁচা দিয়ে পাখিসহ বাসাসমেত গাছ থেকে নিয়ে আসে। খোঁচা খেয়ে পাখিটি তাৎক্ষণিক মারা পড়ে। অথচ এই পাখির শরীরে ২০ গ্রাম মাংসও মেলে না। এশীয় শাবুলবুলি অত্যন্ত উপকারী পাখি। গাছের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে এরা গাছ রক্ষা করে।
বার্ড ক্লাব সূত্রে জানা যায়, এশীয় শাবুলবুলি পাখিটির লেজ ছাড়া দৈর্ঘ্য ২০ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় ২০ গ্রাম। আর লেজের দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটার। তবে ছেলেপাখির লেজের দৈর্ঘ্য বিশাল- ৩৫ সেন্টিমিটার। ছেলেপাখির দুটি বর্ণপর্ব রয়েছে- ‘সাদা’ ও ‘লাল’ সাদাপর্বে দেহের রঙ বরাবরই উজ্জ্বল। তবে মাথা, গলা, কান-ঢাকনি, ঝুঁটি এবং ডানার পালক কালো থাকে। লালপর্বে এর পিঠের দিক লালচে ও দেহের নিচের দিক ধূসরাভ এবং বাকি অংশ সাদাটে। উভয় পর্বে লেজের পালক ফিতার মতো লম্বা থাকে। ছেলে-মেয়ে উভয়েরই চোখ কালচে বাদামি এবং ঠোঁট নীল-ধূসর। মেয়েপাখির রয়েছে খাটো ঝুঁটি ও ধূসর গলা। কান-ঢাকনি এবং লেজের লম্বা ফিতা নেই। মেয়েপাখির চেয়ে ছেলেপাখির লেজ তিন গুণ বেশি লম্বা।
আলোকচিত্রী রেজাউল হাফিজ রাহী জানান, এই পাখির ছবি তিনি ঠাকুরগাঁও জেলার আকচা কাজীপাড়া এলাকা থেকে গত মে মাসে তুলেছেন। প্রজনন মৌসুমে এদের বিচরণটা একটু বেশি নজরে পড়ে।

লেখক : দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

সূত্র : ৮ জুন ২০১৩ ইং তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ।

Check Also

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ব্যাঙ সংরক্ষণ দিবস উদযাপন

জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং গবেষণায় তরুণ শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে ২৯ এপ্রিল শনিবার দ্বিতীয়বারের মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ন্যাচার ক্লাবের আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ব্যাঙ সংরক্ষণ দিবস ২০১৭ উপলক্ষে আয়োজিত হয়ে গেলো আলোচনা সভা ও চিত্রপ্রদর্শনী

বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় চাইনিজ বনরুই; আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে গবেষণাপত্র প্রকাশিত

পরিবেশ সচেতন পাঠক, পার্বত্য চট্টগ্রামে বনরুই এর বর্তমান পরিস্থিতি হতাশাজনক হলেও, গবেষকগণ লাউয়াছড়ার মাটিতে বিভিন্ন গর্তে উঁকি মেরে তুলনামূলক আশার আলো বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন। লাউয়াছড়ায় চালানো বিভিন্ন গবেষণার ফল বলছে, এখানে এখনো তুলনামূলক বেশ সংখ্যক বনরুই নীরবে বসবাস করছে। এমনকি চা-বাগানের শ্রমিকরা জানিয়েছেন, মনোকালচার টি স্টেটে বনরুইদের সাক্ষাৎ প্রায়ই পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চমৎকার জীব-বৈচিত্র্যের ঠিকানা এই বাংলাদেশ থেকে বনরুই এর পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে কেন ! বনরুই-এর উদাহরণ সামনে রেখে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণিদের দেখভাল সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, এই বিষয়ে একটু কি খটকা লাগছে না?

3 comments

  1. nice article. people must have this spirit to present our beautiful birds…..

  2. Hi admin! Really nice article with a nice comment.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *