খয়রা চখাচখি

খয়রা চখাচখি (বৈজ্ঞানিক নাম: Tadorna ferruginea) (ইংরেজি: Ruddy Shelduck), চকাচকি বা চখাচখি অ্যানাটিডি গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত  টাডোর্না গণের এক প্রজাতির দারুচিনি রঙের বড় আকারের হাঁস। চখাচখির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ মরচে-রঙ চখাচখি (ফরাসি tador = চখাচখি; ল্যাটিন ferrugineus = মরচে-রঙ)। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস। গত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা কমে গেলেও আশংকাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছায় নি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে Least Concern বা ন্যুনতম বিপদযুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। চখাচখি বলতে আসলে একটিমাত্র হাঁসকে বোঝায় না, বরং এক জোড়া হাঁসকে বোঝায়। জোড়ার পুরুষ হাঁসটিকে চখা আর স্ত্রী হাঁসটিকে চখি নামে ডাকা হয়। চখাচখি সবসময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে আর জোড়ের বন্ধন খুব শক্ত। একারণেই এদের এমন নাম।

422px-A_couple_of_Tadorna_ferruginea শীতে বাংলাদেশে এরা পরিযায়ী হয়ে আসে। এসময় বাংলাদেশের বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের হাওর ও নদনদীতে এদের দেখা যায়।

চখাচখি বেশ বড় আকারের হাঁস। এদের দৈর্ঘ্য কমবেশি ৬৪ সেন্টিমিটার, ডানা ৩৬ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৪.৩ সেন্টিমিটার, পা ৬ সেন্টিমিটার ও লেজ ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। চখা ও চখির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। চখা কমলা-বাদামি থেকে দারুচিনি বর্ণের। মাথা ও ঘাড় হালকা বাদামি। ডানায় ধাতব-সবুজ পতাকা ও সাদা ঢাকনি-পালক থাকে। প্রান্ত-পালক ও লেজ কালো। প্রজনন মৌসুমে চখার গলায় সরু কালো বলয় হয়। চখি চখার চেয়ে আকারে সামান্য ছোট। চখির মাথা ফিকে রঙের, গলায় বলয় হয় না। চখাচখি উভয়ের চোখ বাদামি; ঠোঁট, পা ও পায়ের পাতা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্ক হাঁস দেখতে চখির মত, তবে ডানার গোড়ার পালক ও ঢাকনি-পালক ধূসর বর্ণের।

চখাচখি পলিময় উপকূল, হ্রদ, বড় নদীর চর ও হাওড়ে বিচরণ করে, ঘন ঘাস বা ঝোপসম্বৃদ্ধ জলাশয় এড়িয়ে চলে। সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। তবে শীতকালে ছোট ছোট ঝাঁকে বিচরণ করে। এরা প্রধানত নিশাচর। তবে ভোরবেলা ও সন্ধ্যাবেলা সক্রিয় থাকে বেশি। এরা কখনও হাঁসের মত নরম কাদামাটিতে আবার কখনও রাজহাঁসের মত আর্দ্র তৃণভূমিতে খাবার খুঁজে বেড়ায়। চখাচখি সর্বভূক; এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে শস্যদানা, অঙ্কুরিত উদ্ভিদ, নরম পাতা, চিংড়ি ও কাঁকড়াজাতীয় প্রাণী, শামুক, জলজ পোকামাকড়, কেঁচো, ব্যাঙ, সরীসৃপ ইত্যাদি। সাঁতার কাটার সময় এদের শরীরের সামনের দিকের অনেকাংশ পানিতে ডুবে থাকে। প্রজনন মৌসুমের পর প্রায় এক মাস যাবৎ এরা উড়তে পারে না। এসময় তাদের শরীরের সমস্ত পালক পরিবর্তিত হয়। 

মে-জুন মাস এদের প্রজননকাল। এ সময় তিব্বত ও উত্তর এশিয়ার অন্যান্য অংশে এদের প্রজনন ঘটে। উঁচু মালভূমির মধ্যে যে সব বাদা আর জলাভূমি আছে, তার পাশে মাটির গর্তে পালক দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো গজদন্তের মত সাদা হয়। ডিমগুলো সংখ্যায় ৬-১০টি হয়। ডিমের মাপ ৬.৫ × ৪.৫ সেন্টিমিটার। চখি একাই ডিমে তা দেয়। এ সময় চখা বাসা পাহারা দেয়। ২৮-৩০ দিনে ডিম ফোটে। ছানারা প্রায় ৫৫ দিনে উড়তে শেখে। দুই বছর বয়সে তারা বয়োঃপ্রাপ্ত হয়।

আবাসন ধ্বংস, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, দূষণ, বার্ড ফ্লু ইত্যাদি নানা কারণে চখাচখির অস্তিত্ব বিশ্বব্যাপী হুমকির সম্মুখীন। মাংসের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক হারে চখাচখি শিকার করা হয়।

Check Also

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ব্যাঙ সংরক্ষণ দিবস উদযাপন

জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং গবেষণায় তরুণ শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে ২৯ এপ্রিল শনিবার দ্বিতীয়বারের মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ন্যাচার ক্লাবের আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ব্যাঙ সংরক্ষণ দিবস ২০১৭ উপলক্ষে আয়োজিত হয়ে গেলো আলোচনা সভা ও চিত্রপ্রদর্শনী

বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় চাইনিজ বনরুই; আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে গবেষণাপত্র প্রকাশিত

পরিবেশ সচেতন পাঠক, পার্বত্য চট্টগ্রামে বনরুই এর বর্তমান পরিস্থিতি হতাশাজনক হলেও, গবেষকগণ লাউয়াছড়ার মাটিতে বিভিন্ন গর্তে উঁকি মেরে তুলনামূলক আশার আলো বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন। লাউয়াছড়ায় চালানো বিভিন্ন গবেষণার ফল বলছে, এখানে এখনো তুলনামূলক বেশ সংখ্যক বনরুই নীরবে বসবাস করছে। এমনকি চা-বাগানের শ্রমিকরা জানিয়েছেন, মনোকালচার টি স্টেটে বনরুইদের সাক্ষাৎ প্রায়ই পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চমৎকার জীব-বৈচিত্র্যের ঠিকানা এই বাংলাদেশ থেকে বনরুই এর পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে কেন ! বনরুই-এর উদাহরণ সামনে রেখে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণিদের দেখভাল সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, এই বিষয়ে একটু কি খটকা লাগছে না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *